চারদিকে ভয়, তাঁরা অকুতোভয়
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি কাভার করেছি ১১ জুলাই থেকে। আর শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয় ৫ আগস্ট। এই ২৬ দিন টানা মাঠে থেকে দেখেছি সব দৃশ্যপট।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলন ঘোষণার পর পরিস্থিতি কী হতে পারে, তা নিয়ে উৎকণ্ঠা ছিল। ৪ আগস্ট আমাকে দিনের কাজ (অ্যাসাইনমেন্ট) দেওয়া হয়েছিল শাহবাগ এলাকায়।
সকাল ১০টার দিকে দেখি শাহবাগ মোড় বেশ নীরব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাউকে দেখলাম না। কিছুক্ষণ পর সেখানে আওয়ামী লীগের ৪০ থেকে ৫০ জন নেতা-কর্মীকে দেখি। তাঁরা আন্দোলনকারী সন্দেহে পথচারীদের মারধর করেছিলেন। সাড়ে ১০টার দিকে টিএসসির দিক থেকে কয়েক শ যুবক লাঠিসোঁটা হাতে শাহবাগ মোড়ে এসে আওয়ামী লীগের লোকদের ধাওয়া দেন। ধাওয়া খেয়ে তাঁরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ঢুকে পড়েন। সেখান থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। একপর্যায়ে বিএসএমএমইউতে গাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়, কয়েকটি গাড়িও জ্বালিয়েও দেওয়া হয়।
এরপরই পুরান ঢাকা থেকে মানুষজন শাহবাগ মোড়ে আসতে থাকেন স্রোতের মতো। সবার হাতেই ছিল লাঠিসোঁটা। তাঁরা নানা রকম স্লোগান দিচ্ছিলেন।
বেলা দুইটার দিকে কিছুক্ষণ পরপরই কারওয়ান বাজার ও বাংলামোটরের দিক থেকে গুলির শব্দ আসছিল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা কারওয়ান বাজার মোড়ে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁরা বাংলামোটর মোড়ে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছেন।
আমি তখন দাঁড়িয়ে ছিলাম পরীবাগ এলাকায়। কিছুক্ষণ পরপরই গুলিবিদ্ধ লোকদের রিকশায় করে শাহবাগ মোড়ের দিকে নিয়ে যেতে দেখি। তবে গুলিবিদ্ধ এত মানুষকে দেখেও আন্দোলনকারীদের চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ দেখিনি, দেখেছিলাম উল্টো নিরস্ত্র থেকেই অস্ত্রধারীদের ধাওয়া দিয়ে কারওয়ান বাজার এলাকাছাড়া করার দৃশ্য।
নির্বিচার গুলি হচ্ছে—এমন পরিস্থিতিতে মাঠে থেকে সাংবাদিকতা অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা। আন্দোলনকারীদের কখন কার গায়ে এসে গুলি লাগবে, তা নিয়ে ভ্রুক্ষেপ দেখিনি। তবে নিজের মধ্যে কিছুটা সংশয় কাজ করছিল। এমন পরিস্থিতিতেই অলিগলি হয়ে পৌঁছাই কারওয়ান বাজার মোড়ে। এসে দেখি অস্ত্র হাতে আওয়ামী লীগের লোকেরা আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করার চেষ্টা করছেন। পিস্তল ও শটগানে বুলেট ভরে কিছুক্ষণ পরপর গুলি করছেন। গুলিতে কেউ পড়ে গেলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন।
বিকেল পাঁচটার দিকে আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগের লোকদের ধাওয়া দিয়ে ফার্মগেটের দিকে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর কয়েক শ পুলিশ নিয়ে আবারও আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন তাঁরা। কিন্তু এরপরও তাঁরা পেরে ওঠেননি। কারণ, আন্দোলনকারীরা ছিলেন অকুতোভয়। রাত আটটার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
ডেটলাইন ৫ আগস্ট
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের দিন আমার অ্যাসাইনমেন্ট শাহবাগ মোড়ে। সকালে মিরপুরের বাসা থেকে মোটরসাইকেলে কারওয়ান বাজারে আসি। রিকশায় রওনা হই শাহবাগের দিকে। ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে গেলে সেনাসদস্যরা আটকে দেন। তাঁরা বলেন, মূল সড়ক হয়ে শাহবাগ মোড়ে যাওয়া যাবে না। চাইলে গলি দিয়ে যেতে পারি। ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড় থেকে পশ্চিম দিকের গলিতে গিয়ে দেখি হাজারো মানুষ। ভিড় ঠেলে শাহবাগ মোড়ে গিয়ে দেখি কিছু সেনা ও পুলিশ সদস্যের অবস্থান।
বেলা একটার দিকে হঠাৎ বিএসএমএমইউর পশ্চিম পাশের গলি থেকে কয়েক শ মানুষ (আন্দোলনকারী) ছুটে আসেন শাহবাগ মোড়ে। পুলিশ তখন তাঁদের বাধা দিতে চাইলে সেনাসদস্যরা ঢাল হয়ে দাঁড়ান। শাহবাগ মোড়ে আন্দোলনকারীদের কয়েকজন সেনাসদস্যদের বলতে থাকেন, ‘পুলিশ আমাদের গুলি করবে, আমাদের বাঁচান, দেশটাকে বাঁচান।’
মুহূর্তের মধ্যেই টিএসসির দিক থেকে মিছিল আসা শুরু হয় শাহবাগ মোড়ে। একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা শাহবাগ থানার সামনে চলে যান। মিছিল আসতে থাকে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে। ইতিমধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন। এর কিছুক্ষণ পরই খবর ছড়ায় শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। কেউ কেউ বলাবলি শুরু করেন, হাসিনা দেশ ছেড়েছেন। পরক্ষণেই বন্ধ থাকা ইন্টারনেট সংযোগ সচল হয়। তাঁর দেশ ছাড়ার খবর জানাজানি হয়। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন আন্দোলনকারীরা।
গুলি করতে করতে তাঁরা ক্লান্ত
শুরুতে বলেছি, আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি কাভার করেছি ১১ জুলাই থেকে। ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা ছিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের। বৃষ্টিতে ভিজেই ওই দিনের কর্মসূচিতে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেন। সেদিনই শিক্ষার্থীরা প্রথমবারের মতো পুলিশের অবরোধ ভেঙে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়েছিলেন।
১৯ জুলাইয়ের একটা ঘটনা বলি। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিএনপির সমাবেশ ছিল। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দলটিকে কর্মসূচি পালন করতে দেননি। সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও গুলি করে দলটির নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়।
ওই দিন বিকেল চারটার দিকে প্রেসক্লাবের উল্টো পাশের সড়কে গিয়ে দেখি বিজিবি সদস্যরা রাস্তায় শুয়ে আছেন। জানতে চেয়েছিলাম রাস্তায় শুয়ে আছেন কেন। জবাব দিয়েছিলেন গুলি করতে করতে তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন, পরিস্থিতি কেমন দেখেছি অর্থাৎ বিএনপির লোকজন আহত হয়েছে কেমন। বললাম, একজনের পায়ে গুলি লেগেছে। তখন বিজিবির এক সদস্য হেসে বললেন, ‘আমার টার্গেট মিস হয়নি। আমি তো পা লক্ষ্য করেই গুলি করেছিলাম।’
মা-বাবা ফোন করতেন প্রতিদিনই
ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন কাভার করতে গিয়ে হয়েছে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। হঠাৎ ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ায় অসম্ভব বিড়ম্বনায় পড়েছি। এমনও হয়েছে পুরো নিউজ এসএমএস আকারে লিখে অফিসে পাঠাতে হয়েছে। না হয় ফোন করে দিতে হয়েছে। একদিকে কারফিউ, অন্যদিকে সংঘাত—এমন উৎকণ্ঠার মধ্যেই কাজ করতে হয়েছে।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে গ্রামে থাকা মা-বাবা প্রতিনিয়ত ফোন করে খোঁজখবর জানতে চাইতেন। তাঁদের বলতাম, অফিস থেকে আমাকে নিরাপদ অ্যাসাইনমেন্ট (দিনের কাজ) দেওয়া হয়েছে। দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, ঝুঁকি নিয়েই জুলাই-আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আমাদের পেশাগত কাজ করতে হয়েছে। আমরা পিছপা হইনি।
মোহাম্মদ মোস্তফা: নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রথম আলো