খেলাপি-ব্যাধি ও নিরাময়ের নিদান

ব্যাংক খাতের সংস্কার মানে আগে রাজনীতির সংস্কারছবি: প্রথম আলো

ধনিক শ্রেণি যদি কর না দেয়, তাহলে তা অর্থনীতির অপূর্ণতা বা ঘাটতি। কিন্তু ধনিক শ্রেণি যখন ব্যাংক গ্রাস করে, তখন তা হয়ে দাঁড়ায় এক দুরারোগ্য মরণব্যাধি। এই ব্যাধির মূল সংক্রামক দূষিত রাজনীতির লুণ্ঠনপ্রবণতা, যার পেশাদারি নাম খেলাপি ঋণ। তাই ব্যাংক খাতের সংস্কার মানে আগে রাজনীতির সংস্কার। সুশাসনের অভাবে এই খাতের খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে ১৯৮০–র দশকের শুরু থেকেই। তখন সরকারগুলো তাদের সমর্থনের ভিত মজবুত করার জন্য ব্যবসায়ী শ্রেণির সমর্থন চাইত। ব্যবসায়ীরা সানন্দে তা দিতে প্রস্তুত দুই শর্তে—১. তাদের প্রার্থিত পুঁজি দিতে হবে; ২. ব্যাংকিং ব্যবসাকে ব্যক্তিমালিকানায় ছাড়তে হবে। সরকার সানন্দে তা মেনে নেয়।

এই খাতের দূষণপ্রক্রিয়া গত ১০ বছরে যতটা প্রকট ও দুরারোগ্য হয়েছে, এর আগের ৩৩ বছরেও তা হয়নি। ভারতীয় অর্থনীতিতে শ খানেক বাণিজ্যিক ব্যাংক কাজ করছে। তাদের অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে সাত-আট গুণ বড়। সে অনুপাতে বাংলাদেশে গোটা বিশেক ব্যাংক থাকাই যথেষ্ট। কিন্তু এখানে ৬০টির বেশি ব্যাংক। মানে ব্যাংক গজিয়েছে পারিবারিক দোকানের মতো। এগুলো প্রতিযোগিতার নয়, অসুস্থ রাজনীতির লক্ষণ। কারণ, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক গোষ্ঠীতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত।

এদের পেছনে ছিল দূষিত ক্ষমতাসীন রাজনীতিক ও লুটেরা ব্যবসায়ীদের মধ্যকার এক অলিখিত বোঝাপড়া, যা দিয়ে খেলাপি ঋণ বাড়িয়ে শেষতক মুদ্রা পাচার নিশ্চিত করা যায়। এখানে প্রতিযোগিতার জন্য সংখ্যা বাড়ানো হয়নি; বরং চট্টলার ব্যাংকখেকো একটি পরিবারকেই দেওয়া হয়েছে সাতটি ব্যাংক। ঢাকার এক ‘দরবেশ’ পরিবার অবাধে সরকারি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে তা ফেরত না দিয়ে যেন স্বাচ্ছন্দ্যে সমাজে জাতির উপদেষ্টা হয়ে বিরাজ করতে পারে, সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করে দিয়েছে বিগত সরকার।

‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা’ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে ব্যাংক খাতকে। তাই একে নিয়ে সংস্কারের কথা বলা অর্থহীন। দেহের কোথাও কেটে গেলে রক্তক্ষরণ রোধে ডাক্তার ব্যান্ডেজ দিতে পারেন। কিন্তু রক্ত পচে গেলে ব্যান্ডেজ অবান্তর। আওয়ামী লীগের সরকার তাদের উন্নয়নের প্রচার দিয়েছে। কিন্তু ব্যাংক খাতে তাদের উন্নয়ন ছিল একদিকে সংখ্যার বৃদ্ধি, অন্যদিকে মানের সর্বৈব পতন। শেষ দিকে সরকার খেলাপি ঋণের অধঃপতিত নবসংজ্ঞায়ন ও পরিচালক নীতির স্খলন নিশ্চিত করে ব্যাংক খাতের বিপর্যয়কে অনিরাময় ক্যানসারে পরিণত করেছে।

এই অনৈতিক কর্মে সরকারের কুশীলব ছিলেন ২০১৯-২০২৩ কালপর্বের হিসাববিদ অর্থমন্ত্রী ও তাঁর যোগ্য শাগরেদ দুজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব–গভর্নর। এই তিনজনের কেউই তাঁদের নিজ নিজ পদের জন্য যোগ্য ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের মাধ্যমে লুটেরা কয়েকটি পরিবারের অর্থ-তস্করতা হাসিল করা সম্ভব জেনেই আওয়ামী লীগ সরকার তাঁদের এসব পদে বসিয়েছিল। জ্ঞানের বদলে প্রয়োজন ছিল আনুগত্য ও প্রশ্নহীন আজ্ঞাবহতার। তাই পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার যেন ঠিক এই কাজটিই আবার করতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই ব্যাংক খাত সংস্কারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

২০২৪ সালের আগস্ট নাগাদ ব্যক্তিখাতে মোট ঋণের পরিমাণ ১৬ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেখানো হচ্ছে মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আসলে এর এক-চতুর্থাংশই অনাদায়যোগ্য ঋণে পরিণত হয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার শুরুতে পেয়েছিল ২২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। যাওয়ার বেলায় এটিকে তারা কৃত্রিমভাবে কমানো হিসাব ধরলেও তুলে দিয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকায়; অর্থাৎ প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার ফাও সুবিধা ধনিক গোষ্ঠীর পকেটে দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, প্রকৃত খেলাপি শতকরা প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২ লাখ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে মাত্র দু-চারটি পরিবার। গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন গভর্নরের নেতৃত্বে এই ‘আউলিয়া-দরবেশ’দের বিরুদ্ধে উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছে, যা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে আরও প্রকট করেছে।

কী কী সংস্কার দরকার, তার ফর্দে শ দুয়েক উপাদান থাকলে তা সুখপাঠ্য নয়। বরং দেখা উচিত কী কী পরিবর্তন ব্যাংক খাতকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সেই পরিবর্তনগুলো ওলটানো সংস্কারের প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপে থাকবে এই অর্ধমৃত খাতকে কীভাবে গতিশীল করা সম্ভব, তার উপায় বের করা। তৃতীয় ধাপে থাকবে অন্যান্য দেশের উত্তম চর্চার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক ও অর্থ খাতের উন্নয়নে কিছু কর্মসূচি ঠিক করা, যা দেশকে একটি আধুনিক অর্থনীতিতে পরিণত করবে।

বিরূপাক্ষ পাল

ব্যাংক খাতে বিকৃতির সবচেয়ে বড় ঘটনার নাম খেলাপি ঋণের উদ্ভট নবসংজ্ঞায়ন। এটি শুরু হয় ঋণ পুনঃকাঠামোকরণের মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালের পর। এখানে বড় ঋণে বড় ছাড় ছিল, যা অনৈতিক। এতেও লুটেরা ধনিকেরা ততটা সন্তুষ্ট ছিলেন না। ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর নতুন মন্ত্রিসভায় এমন একজন চতুর হিসাববিদকে আওয়ামী লীগ অর্থমন্ত্রী বানায়, যাঁর নাম তখনই নানা অনিয়মে জড়িত ছিল। তিনি অর্থনীতির সাপ-ব্যাঙ কিছুই বুঝতেন না। তবে আর্থিক তথ্যের বিকৃতিকর্মে তাঁর হাতযশ ছিল। তা ছাড়া তিনি ধনিক গোষ্ঠীর সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষা করবেন, এমন নামডাক আগে থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারকে আশ্বস্ত করেছিল। তিনি অর্থমন্ত্রী হয়েই খেলাপি ঋণের শিথিল সংজ্ঞায়ন করলেন। তাঁর অনুগত গভর্নর ফজলে কবির তা প্রতিপালন করলেন। কিন্তু গভর্নর তালুকদার চেয়ারে বসার পাঁচ দিনের মধ্যেই দেখিয়ে দিলেন যে তিনি এই সংজ্ঞাকে আরও লুটেরাবান্ধব করে দিতে পারেন। সংস্কারের প্রথম ধাপেই খেলাপি ঋণের সংজ্ঞাকে বৈশ্বিক মাপকাঠিতে নিয়ে যেতে হবে।

গভর্নর তালুকদার আরও এক কাঠি ওপরে উঠে আরেক সুবিধা প্রদান করলেন। আগে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের একটি ব্যবসা খেলাপি হলে একই মালিকের অন্য ব্যবসাগুলো ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা হারাত। তালুকদার নিয়ম করলেন যাতে খেলাপিরা অন্য ব্যবসা দেখিয়ে যথারীতি ঋণ পায়। এটিকে পূর্বাবস্থায় নিতে হবে। বর্তমানে পরিচালক নিয়োগ ও তাঁদের স্থায়িত্বের আইনে পরিবর্তন এনে ব্যাংকগুলোকে ‘পারিবারিক দোকান’–এর ভাবমূর্তি থেকে মুক্ত করা প্রয়োজন। এদের ‘করপোরেট কালচার’–এর যোগ্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়ে প্রজ্ঞাবান ও অভিজ্ঞ মানুষদের নিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ গড়তে হবে। তাদের কর্মকালও হবে সীমিত।

বিলুপ্ত করতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, যার মধ্য দিয়ে লুটেরা সম্প্রদায় তাদের দলভুক্ত মন্ত্রীকে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর প্রভাব খাটিয়ে ইচ্ছেমতো তহবিল বাগিয়ে নিতে পারে। ব্যাংকের ষাটোর্ধ সংখ্যাকে কমিয়ে সিনার্জি বিবেচনা করে মার্জারের মাধ্যমে ২০–২৫টিতে নামিয়ে আনতে হবে। খেলাপি ঋণের ব্যাপকসংখ্যক মামলা ও প্রচলিত আদালতের দীর্ঘসূত্রতা কোনো দিনই খেলাপি ঋণ কমাতে সহায়ক হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে আলাদা খেলাপি ঋণ বিচারালয় গড়ে গভর্নরকে বিচারিক ক্ষমতা দিতে হবে। এ জন্য গভর্নরের পদটি হওয়া উচিত সাংবিধানিক। তিনি সংসদে জবাবদিহি করবেন। সহযোগিতা করবেন অর্থ মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু মন্ত্রণালয় কখনোই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রভু হবে না। ওরা রাজস্ব ও বাজেট দেখবে। ব্যাংক দেখবে মুদ্রানীতি, প্রবৃদ্ধি, নিয়োগ, আমানত, বিনিয়োগ, ব্যবসায়িক উদ্যোগ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও রিজার্ভ সংরক্ষণের দিকগুলো।

পুঁজিবাজারে কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যবসা ব্যাংক খাত থেকে ঋণ পাবে না। প্রতিযোগিতা বিনষ্টকারীরা সে রকম আইনে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। মুদ্রা পাচারজনিত যেকোনো অভিযোগে বিচারাধীন মামলায় জড়িত কোনো ব্যবসা ব্যাংকঋণের যোগ্য হবে না। কর ফাঁকিদাতারা ঋণ পাওয়ার যোগ্য হবে না। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তাৎক্ষণিক তথ্য ও সহযোগিতা প্রদানে বাধ্য থাকবে পাঁচটি সংস্থা— ১. সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন, ২. দুদক, ৩. ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, ৪. প্রতিযোগিতা কমিশন এবং ৫. রেভিনিউ বোর্ড। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ন্যায্য ক্ষমতায়ন না ঘটিয়ে ব্যাংক খাতের কোনো সংস্কারই শেষ পর্যন্ত কাজে দেবে না। অন্যদিকে রাষ্ট্র সংস্কারের যে দাবি আজ উঠেছে, ব্যাংক খাতের সংস্কার ছাড়া তা হবে অপূর্ণ ও অর্থহীন।

* বিরূপাক্ষ পাল: যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডে অর্থনীতির অধ্যাপক