বর্তমানে যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে, তার পেছনে তিনটি অনুঘটক একসঙ্গে কাজ করেছে। কোভিড–উত্তর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কারণে সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্ন হওয়ায় বিশ্বে শিল্পের কাঁচামালের দাম বেড়ে যায়। এর সঙ্গে ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ যুক্ত হয়ে সংকট আরও তীব্র করে তোলে। এ কারণে সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি ঘটে। প্রাথমিক চাপ শুরু হয় জ্বালানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে, পরে খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যেও তা
ছড়িয়ে পড়ে। এ দুইয়ের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড,
ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের সুদহার খুব দ্রুত ও বড়ভাবে বাড়িয়ে দেয়। ফলে বৈশ্বিক তারল্যে
প্রভাব পড়ে।
এর প্রতিক্রিয়ায় শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিকভাবেই মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ধাক্কা লাগে। জ্বালানি তেল, গ্যাস, শিল্পের কাঁচামাল, খাদ্যপণ্যসহ আমরা যেসব পণ্য আমদানি করি, সেগুলোর দাম অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু তৈরি পোশাকসহ যেসব পণ্য রপ্তানি করি, সেগুলোর দাম বাড়েনি। এর কারণে আমরা একটা বাণিজ্যঘাটতিতে পড়েছি। গত অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার ধার করতে হয়েছে। বর্তমানে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ১৭ থেকে ১৮
বিলিয়ন ডলার।
বিপুল অঙ্কের টাকা ধার করে আমরা বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু বাজার তো ঠিকই জানে আমাদের অর্থনীতি একটা সমস্যার মধ্যে পড়েছে। আমাদের একটা ফিন্যান্সিং গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে। মুদ্রাবাজারে ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার অনেক বেড়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের আগে থেকেই একটা কৌশলগত ভুল ছিল। ভারতের মতো আমরা টাকার মান ধীরে ধীরে অবমূল্যায়ন না করে জোর করে টাকার বিনিময় হার ধরে রাখা হয়েছিল। ফলে বিশাল একটা চাপ এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছিল। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন তাই অনেক বেশি করতে হয়েছে। ভারতে যেখানে ১১ শতাংশ হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে হয়েছে ২৫ শতাংশ। আর খোলাবাজারে অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায়
৩০ শতাংশ।
টাকার অবমূল্যায়ন হলেও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় বাজার এখনো স্থিতিশীল হয়নি। এখনো প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রিজার্ভ বিক্রি করতে হচ্ছে। এর পরিমাণ প্রতি মাসে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের মতো।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর কত দিন রিজার্ভ বিক্রি করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে? চার মাসের বেশি এভাবে চলতে থাকলে আমাদের অর্থনীতি বিশাল ক্ষতির মুখে পড়বে। আমাদের প্রকৃত রিজার্ভ এখন ২৮ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ গেলে চার মাসে আরও ৫ বিলিয়ন ডলার শেষ হয়ে যাবে। ২৩ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ সর্বনিম্ন চূড়া। এর নিচে নেমে গেলে বাজারে আস্থার সংকট সৃষ্টি হবে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় বাজার স্থিতিশীল করতে গেলে সরকারকে তিন মাসের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমত, সুদহার অনেকখানি বাড়াতে হবে। পৃথিবীর সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার ৩ থেকে ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। আমাদের মূল্যস্ফীতি যখন ৫ শতাংশে ছিল, তখন যে সুদহার ছিল, এখন যখন মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশ, তখনো একই সুদহার ধরে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলারের বিপরীতে টাকা আকর্ষণীয় করতে হলে সুদহার বাড়াতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমানোর হাতিয়ার হিসেবে সুদহার নীতি সরকার ব্যবহার করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণসহায়তার আলাপ চলছে সরকারের। এটা চূড়ান্ত করা প্রয়োজন। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এই ঋণ পাওয়া গেলে রিজার্ভ প্রাণ ফিরে পাওয়ার মতো ডলার পাওয়া যাবে, বাজারে আস্থা তৈরি হবে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন হবে। আমাদের রাজস্ব খাত, আর্থিক খাত, বিনিময় বাজার ব্যবস্থাপনা সংস্কারের প্রয়োজন। সুদহার নীতি নমনীয় ও করনীতি সংস্কার করা প্রয়োজন। সব মিলিয়ে সংস্কারে হাত দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। আমাদের নীতিনির্ধারকদের বদ্ধমূল ধারণা হলো, কোনো সংস্কার না করলেও প্রবৃদ্ধি, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা চলতে থাকবে। এই মিথ ভাঙার সময় এসেছে।
তৃতীয়ত, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময় সরকারকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে ব্যয় বাড়াতে হবে। সম্প্রতি এই ব্যয় কিছুটা বেড়েছে। এর আওতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। তৃতীয় একটা পক্ষের মাধ্যমে জরিপ চালিয়ে দেখা প্রয়োজন প্রকৃত ভুক্তভোগীরা সহায়তা পাচ্ছে কি না।
চতুর্থত, মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে এখন সরবরাহব্যবস্থায় মনোযোগ দিতে হবে। আমন ধান ঠিকমতো ঘরে তুলতে হবে। সামনে বোরো মৌসুম। হাওরে ধান যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য এখন থেকেই বাঁধ নির্মাণ শুরু করতে হবে। শীতের ফসল যাতে কৃষক ভালোভাবে ঘরে ওঠাতে পারেন, সেদিকে নজর দিতে হবে। সরকার এখন পর্যন্ত সারে ভর্তুকি দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু করেনি। সেই ভর্তুকি আবার কৃষক ঠিকমতো পাচ্ছেন না। কৃষি খাত ব্যবস্থাপনা, বাজার সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় যেন দুর্নীতি, চাঁদাবাজি না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। বাজার স্বস্তিতে রাখতে হবে।
পঞ্চমত, অভ্যন্তরীণ চাহিদাও এখন কমিয়ে আনতে হবে। কিছুটা কমেছে, এলসিও কম খোলা হচ্ছে। কিন্তু এলসি নিষ্পত্তির সংখ্যা এখনো বেশি। এলসি নিষ্পত্তি কমে গেলে বাজারে কিছুটা স্বস্তি আসবে। সরকার বেশ কিছু ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন করছে, সেটা বাড়াতে হবে। বিদ্যুতের সরবরাহ যেকোনো মূল্যে আগের পর্যায়ে নিতে হবে। লোডশেডিং বন্ধ করতে হবে। এটা ক্ষতিকর। উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
দেশে একটা সংকট চলছে। সেটা মোকাবিলায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেখতে পাচ্ছি না। সমস্যা কত বড়, সেটার স্বীকৃতি আমরা দেখতে পাচ্ছি না। জটিল সিদ্ধান্তগুলোর জন্য সরকারের একটা কৌশলগত রোডম্যাপ থাকা দরকার। এ বছর ও আগামী বছর আমাদের অর্থনীতি সংহত করার বছর। এখানে প্রবৃদ্ধির দিকে তাকিয়ে লাভ নেই, প্রবৃদ্ধি যা হওয়ার হবে। অবশ্যই মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
লেখক: পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক