ছাত্র এবং পুত্রের কাছে পরাজয়ে আনন্দ আছে
শিশুর বয়স বাড়ার সঙ্গে তার মা যে বদলাতে থাকে—এই তথ্য কি কোনো শিশু জানে? শিশুর বয়স যখন দুই, তখন তার মা এবং শিশুর বয়স যখন আট, তখনকার মা দুই মানুষ।
অতি শৈশবের মাকে আমার মনে নেই। যে মাকে মনে আছে, তাঁর বয়স আঠারো-উনিশ। ঝলমলে তরুণী। যে তাঁর বিশাল সংসার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। বিশাল সংসার, কারণ স্বামী-পুত্র-কন্যা ছাড়াও সংসারে বাড়তি দুজন—একজন দেবর, আরেকজন তাঁর ছোট ভাই। এই দুজনের প্রধান কাজ সারা দিন খটাস খটাস শব্দে ক্যারম খেলা এবং প্রতিবছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে ফেল করা। রেজাল্ট আউট হওয়ার পরের কয়েক দিন ক্যারম খেলা বন্ধ থাকে, আবার শুরু হয় খটাস খটাস।
আঠারো-উনিশ বছরের একজন তরুণীর চোখে নানান স্বপ্ন থাকে। আমার মায়েরও নিশ্চয়ই ছিল। স্বপ্নকে প্রবাহিত করার কোনো সুযোগ কি ছিল? আমার মনে হয় না। মহিলার স্বামী মানুষ হিসেবে ইন্টারেস্টিং। ভাবুক, প্রেমিক, জটিলতামুক্ত প্রায় মহাপুরুষ পর্যায়ের একজন। মহাপুরুষ দিয়ে সংসার চলে না। সংসারে চালিকা শক্তি অর্থ। মহাপুরুষের অর্থ ছিল না। তাঁর বেতন ছিল সর্বসাকল্যে আশি টাকা। এই টাকার একটি অংশ চলে যেত দেশের বাড়িতে। একটি অংশ বই কেনায়, ক্যামেরার ফিল্ম কেনায়, একটি অংশ গান-বাজনার আসরে বন্ধুদের পেছনে। বাকি যা থাকত, তা তিনি স্ত্রীর হাতে দিয়ে মধুর হাসি হেসে বলতেন, কষ্ট করে চালিয়ে নাও। মা চোখের পানি ফেলতেন।
পুলিশের চাকরির কারণে বাবা রেশন পেতেন। ভাত-ডালের ব্যবস্থা হতো। বাকি খরচ কোত্থেকে আসবে! পুলিশের রেশনে কাপড় দেয় না। মাকে তাকিয়ে থাকতে হতো তাঁর বাবার দিকে। উনি প্রায়ই কন্যার শাড়ি কিনে পাঠাতেন।
স্বামী-স্ত্রীর নিখাদ ভালোবাসায় সংসার অতি সুখের হয়, এই ধারণা ভুল। সংসার সুখের হতে হলে কিছু অর্থের অবশ্যই প্রয়োজন হয়।
আমার মায়ের নিশ্চয়ই ইচ্ছা করত ভালো কোনো খাবার তাঁর স্বামী-পুত্র-কন্যাদের পাতে তুলে দিতে। তিনি কখনোই তা পারেননি। মায়ের কাছ থেকে শোনা আমাদের বাসার মেনু ছিল—
নাশতা: রুটি, পেঁপেভাজি (আটা পুলিশের রেশনের)।
লাঞ্চ: ভাত, ডাল, ডালের বড়া (ডালের বড়া বানানোর তেল পুলিশের রেশনের)।
ডিনার: ভাত, ডাল, নিমপাতাভাজি (বাসার পেছনে বড় নিমগাছ ছিল। আমরা সেই নিমগাছের সব পাতা ভেজে খেয়ে ফেলেছি।)
সমস্যার এখানেই শেষ নয়, বাবার নিয়ম ছিল কোনো ভিখিরি এসে যদি ভাত চায়, তাকে ভাত খেতে দিতে হবে। ভিখিরিরাও এই খবর পেয়ে গিয়েছিল। প্রতি দুপুরেই তারা নিয়ম করে এসে কুয়াতলায় বসে পরম তৃপ্তিতে ভাত খেত। ভিখিরিদের খাওয়া দেখাটা আমার জন্য খুব আনন্দের ছিল। কী তৃপ্তি করেই না তারা প্লেট চেটেপুটে খেত! দেখে মনে হতো অমৃতসম কোনো খাদ্য খাচ্ছে।
একদিন আমি মাকে বললাম, আমিও ভিখিরিদের মতো কুয়ার পাড়ে বসে টিনের থালায় ভাত খাব।
মা চড় দিয়ে বললেন, কী জন্য?
কুয়ার পাড়ে বসে ভাত খেতে খুবই মজা।
মা তার ছেলের অধঃপতন দেখে রাগে-দুঃখে কেঁদেকেটে অস্থির হলেন। সব ঘটনা শোনার পর বাবা নির্দেশ দিলেন—ছেলেকে দুপুরে কুয়ার পাড়েই ভাত দেওয়া হবে।
আমি তিন-চার বেলা খেয়েছি। আমি এবং আমার ছোট বোন শেফু। দাদাভাই যা করে, শেফুর তা-ই করা চাই। কুয়ার পাড়ে স্বাদের কোনো উনিশ-বিশ না দেখে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া হয়।
মায়ের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সংসারের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ একজন তরুণী। ছেলেমেয়েগুলো প্রচণ্ড দুষ্ট। কেউ ঘরে থাকে না। ঘরে অভাব। তরুণীর দিশেহারা হবারই কথা। সেই বয়সের একটি মেয়ের কোনো শখই পূর্ণ হবার নয়। হঠাৎ হঠাৎ ছবিঘরে ছবি দেখতে যাওয়া। এপাড়া-ওপাড়ায় বেড়ানো। তিনি কখনো তাঁর মেয়েকে নিয়ে, কখনোবা আমাকে নিয়ে নিজের আনন্দে ঘুরে বেড়াতেন। মাঝেমধ্যে নিতান্তই অপরিচিত বাড়িতেও ঢুকে যেতেন।
একবার বাবা খুব রাগ করলেন। কারণ, মা ডিস্ট্রিক্ট জজ সাহেবের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। গল্পগুজব করে এসেছেন। বাবা বললেন, ‘আয়েশা শোনো, আমি নিতান্তই সাধারণ এক পুলিশের দারোগা। জজ সাহেব কত উপরের একজন মানুষ। তুমি কী মনে করে তাঁর বাড়িতে গেলে?’
মা বললেন, ‘অসুবিধা কী? আমার স্বামী সাধারণ একজন দারোগা, কিন্তু আমার ছেলেমেয়েরা একদিন অবশ্যই জজ-ব্যারিস্টার হবে। আমি জজ-ব্যারিস্টারের মা হিসেবে ওই বাড়িতে গিয়েছি।’
বাবা হেসে দিয়ে বললেন, ‘তোমার যুক্তি মানলাম। তুমি যেখানে ইচ্ছা যাবে।’
অভাব-অনটন একেকজনের ওপর একেকভাবে ক্রিয়া করে। অভাব-অনটন মাকে যুক্তিবাদী করল। মায়ের কাছ থেকে আমি শিখেছি লজিক। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, লজিকে কেউ তাঁকে হারাতে পারবে না। তবে আমি কয়েকবার হারিয়েছি। মা নিশ্চয়ই পুত্রের কাছে লজিকে পরাজিত হয়ে খুশি হয়েছেন। কারণ, ছাত্র ও পুত্র এই দুইয়ের কাছে পরাজয়ে আনন্দ আছে। এই দুইয়ের বাইরে কারও কাছে পরাজিত হওয়া দুঃখের ও কষ্টের ব্যাপার।