দেশে ভয়ের পরিস্থিতি রয়েছে: শহিদুল আলম
আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেছেন, ‘দেশের সংবিধান আমাকে যে অধিকার দেয়, তা আদায় করে নেওয়ার ব্যাপার রয়েছে। তার সঙ্গে আরেকটি জিনিস সেটা হচ্ছে, সাহস জোগানো। এখন দেশে ভয়ের পরিস্থিতি রয়েছে—এটা আমরা সবাই জানি। এই পরিস্থিতিতে আমরা জনগণ যে একা না, তা সবাইকে বোঝানোর প্রয়োজন আছে।’
আজ শনিবার দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে শহিদুল আলম এসব কথা বলেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে অনিশ্চয়তা, ভয়ভীতি ও সহিংসতার পরিস্থিতি নিয়ে ‘নাগরিক সমাজের পক্ষে আমরা’ শীর্ষক এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
সম্মেলনে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, প্রত্যেকেই মনে করছে কী হয়, কী হবে, প্রশাসন তাদের হাতে—এত রকমের ক্ষমতা যেখানে, সেখানে জনগণের হাতে যে সবচেয়ে বড় ক্ষমতা, তা বোঝানোর দরকার। জবাবদিহি যে একটি প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেকোনো সরকারই থাকুক না কেন, সে জানবে তার ওপর খবরদারি, নজর আছে এবং যা খুশি করে পার পেয়ে যাবে না।
নির্বাচনকালীন সাংবাদিকদের দায়িত্ব প্রসঙ্গে শহিদুল আলম বলেন, ‘আপনারা জানেন আমাদের ছবি তোলা, রিপোর্টিংয়ের ব্যাপারে অনেকগুলো নিষেধাজ্ঞা আছে, সরকারের যদি ভয়ই না থাকে, তাহলে নিষেধাজ্ঞা দেবে কেন। সুষ্ঠুভাবে, অবাধভাবে যদি নির্বাচন হয়, তাহলে সবাই রিপোর্ট করবে, ছবি তুলবে। নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ভয়টি ইঙ্গিত করে। আমাদের জোরালোভাবে দাবি তোলা দরকার সাংবাদিক হিসেবে যেন আমার দায়িত্ব পালন করতে পারি এবং জনগণকে জানানোর সুযোগ থেকে আমি যেন বঞ্চিত না হই।’
ইতিহাসবিদ, অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী, শিল্পী, শিক্ষকসহ নাগরিক সমাজের ২৯ জন প্রতিনিধির পক্ষ থেকে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে নাগরিকদের পক্ষ থেকে বক্তব্য তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন। তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচন কেমন হবে, আদৌ শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে কি না, সুষ্ঠু, অবাধ হবে কি না, জনমনে তা নিয়ে বিরাজ করছে প্রবল সংশয় এবং অবিশ্বাস। উৎসবের পরিবর্তে আতঙ্ক আর উদ্বেগ ঘিরে রেখেছে মানুষকে। সরকার ও তার সমর্থকদের দায়িত্ব ভয়মুক্ত পরিবেশে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার ব্যবস্থা করা।
নির্বাচনে সাংবাদিকেরা কতটুকু দায়িত্ব পালন করতে পারবে—এমন প্রশ্নের জবাবে গীতি আরা নাসরীন বলেন, ‘সাংবাদিকদের তাঁদের দায়িত্ব পালন করতেই হবে। তাঁদের দায়িত্ব পালনের জায়গা তৈরি করে দিতে হবে। গুজব তখনই তৈরি হবে, যখন সেখান থেকে সত্য খবর পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। তিনি আরও বলেন, মানুষের মধ্যে যখন অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ বাড়বে তখন গুজবের সম্ভাবনাও বাড়বে। এই গুজব যাতে তৈরি না হয়, ভোটকেন্দ্রগুলোতে কী হচ্ছে, আগে-পরের সব খবরের ব্যাপারে গণমাধ্যমকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। দায়িত্ব পালন করতে না দেওয়া হলে তা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। এটা আমরা কেউ চাই না। আমরা ধরে নিচ্ছি এর ব্যত্যয় হবে না। যদি হয় তাহলে আমরা তা জানব, যা করার কথা তা করতে দেওয়া হলো না।’
এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে আনু মুহম্মদ বলেন, বিগত আমলে দলীয় সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন বাংলাদেশে হয়েছে, তার সবগুলোই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, অভিযোগ আছে। বর্তমান সরকারের দাবি, তাদের অধীনেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। এটা এই সরকারের জন্য বড় পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে যেভাবে সরকারের ভূমিকা পালন করা উচিত, তা সরকার করছে না। সরকার উল্টোটা করছে।
সরকারদলীয় প্রার্থী ছাড়া অন্য দল বা জোটের প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারছেন না, এমন অভিযোগ করে আনু মুহম্মদ বলেন, ‘গত কয়েক দিনের সংবাদে দেখা গেছে, সরকার দলীয় প্রার্থী ছাড়া আর কোনো দল, জোট বা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রয়োজনীয় প্রচার চালাতে পারছেন না। অনলাইনেও বিরোধী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নানাভাবে হামলার শিকার হচ্ছেন। একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার তৈরি হয়েছে। যেকোনো মানুষ গুম হতে পারে, ক্রসফায়ারে দেওয়া হতে পারে, হামলা-মামলা হতে পারে, নারী-শিশু-ধর্মীয়-নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু একের পর এক নির্যাতন করা হয়েছে, তাতে ভয়ের বাংলাদেশ হয়েছে, নিরাপত্তাহীনতার শাসন কায়েম হয়েছে। নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা না করা হলে, একটা দেশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ছদ্মবেশে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলে যাবে। আমরা এমন রাষ্ট্র চাই না।’
আনু মুহম্মদ আরও বলেন, ‘গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম—এসব মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া জারি আছে। নির্বাচনকে সামনে রেখেই এই আইন পাস হয়েছে। এই আইনের কারণে, পাশাপাশি বিধিনিষেধ, মৌখিক নির্দেশ-আদেশ এবং হয়রানির কারণে সংবাদমাধ্যমগুলো খুবই ভয়ভীতির মাঝে কাজ করছে, তা আমরাও বুঝতে পারি।’
নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রসঙ্গে আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘আমরা কয়েক দিন ধরে জেনেছি, বিরোধী দলের প্রার্থীদের ওপর হামলা হচ্ছে, সহিংসতা হচ্ছে। কিন্তু পুলিশ একটু দূরেই দাঁড়িয়ে দেখছে। অন্যদিকে এও দেখা যাচ্ছে, সরকারি সমর্থক প্রার্থীরা প্রচারে গেলে শত শত পুলিশ থাকছে, সরকারি গাড়িসহ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এটা করা হচ্ছে। এ রকম একটা অশ্রদ্ধা যদি না থাকত, তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু হতো। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচন কমিশনের অধীনে। ইসি কেন এগুলো দেখে না?’
আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘আইনের শাসনের এবং নীতি নৈতিকতার প্রতি চরম অশ্রদ্ধা বোধ থেকেই বিরোধী প্রার্থীদের ওপর হামলার মতো কাজ হচ্ছে। আমরা আহ্বান জানাই এবং চাপ প্রয়োগ করি যাতে প্রশাসন তার দায়িত্ব পালন করে।’
ইতিহাসবিদ আহমেদ কামাল বলেন, ‘সরকার উন্নয়নের কথা বলছে। অথচ জবাবদিহিমূলক স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা না হয়, তাহলে যে বিদেশি বিনিয়োগের পয়সা বা সমর্থন আশা করে এই সরকার এগোতে চাচ্ছে, সেটা ব্যর্থ হবে। সরকার উন্নয়নের কথা বলছে, তবে এই উন্নয়নের ফল কোথায় নেবে, তা জানি না। জবাবদিহি না থাকলে একদিন না একদিন তরুণ-তরুণীদের মুখোমুখি হয়ে জবাবদিহি দিতে হবে।’
নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, স্বাধীনভাবে দেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের যথাযথ ভূমিকা পালন করার ব্যবস্থা, হামলা, মামলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, সহিংসতা বন্ধ করা, নির্বাচনের সময় ধর্মীয়-সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সকল প্রকার যোগাযোগে বাধা দেওয়ার বদলে উন্মুক্ত করা।