প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে ৪৫ বছরের প্রতিষ্ঠান ছাড়লেন
টেরি গোকে ‘আইফোন’ নির্মাতা হিসেবে চেনেন অনেকেই। আইফোনের যন্ত্রাংশ সংযোজনের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি রয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের। তিনি তাইওয়ানের শীর্ষ ধনী ও প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফক্সকনের প্রতিষ্ঠাতা। ৪৫ বছর পর ফক্সকন ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। এবারের তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার লক্ষ্যেই ফক্সকন ছাড়ছেন তিনি। গত শুক্রবার ফক্সকনের বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নতুন পরিচালনা কমিটির হাতে তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন টেরি। আগামী বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে তিনি এখন কাজ শুরু করবেন।
ফোর্বসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনীতিকে গুরুত্ব দিতেই টেরি গো ফক্সকন ছাড়ার মতো পদক্ষেপ নিয়েছেন। তবে রাজনীতিতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করার আগ পর্যন্ত ফক্সকনের বড় বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা থাকবে। তিনি ফক্সকনের পরিচালনা পর্ষদে সদস্য হিসেবে থাকবেন। তবে তিনি চেয়ারম্যান পদটি ছেড়ে দিচ্ছেন। তাঁর পদে আসছেন প্রতিষ্ঠানটির সেমিকন্ডাক্টর বিভাগের ব্যবস্থাপক লিউ ইয়াং। আগামী ১ জুলাই থেকে এ পরিবর্তন কার্যকর হবে।
৪৫ বছর আগে টেরি গোর হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় ফক্সকনের। নিজেই এত দিন এর পুরো ব্যবস্থাপনা সামলেছেন। ফক্সকন এখন অ্যাপলসহ বিশ্বের শীর্ষ অনেক আইটি ব্র্যান্ডের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে।
তবে রাজনীতিতে নামার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে টেরি গোকে নিয়ে শুরু হয়েছে নানা হিসাব-নিকাশ। তাঁকে চীনঘেঁষা বলে উল্লেখ করছেন অনেকে। তাইওয়ানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েনের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো নয়। চীন তাইওয়ানকে দেশটির সাবেক প্রদেশ হিসেবে বিবেচনা করে। এ কারণে চীন প্রায়ই তাইওয়ানের পুনর্নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে আসছে। এ অবস্থায় টেরি গোকে নিয়ে শুরু থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করছে চীনবিরোধীরা। ২০১৫ সালে শুল্ক বিষয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ন্যাশনালিস্ট পার্টির মা ইং-জেওয়ের সমালোচনা করেও আলোচনায় আসেন টেরি গো। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যে শুল্কারোপের বিরোধিতা করেন তিনি। এ ছাড়া ২০১৬ সালে সরকারের অপরিকল্পিত খরচের সমালোচনা করতেও পিছপা হননি। তবে গণমাধ্যমের সঙ্গে খুব বেশি কথা বলেন না টেরি গো। এখানে তিনি তাইওয়ানের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের চেয়ে আলাদা। পরিশ্রমী ও দানশীল হিসেবে পরিচিত টেরি গোর সমর্থনেও রয়েছেন অনেকে। তবে তাঁর কারখানার কয়েক শ্রমিকের আত্মহত্যার ঘটনাটি নির্বাচনকে কেন্দ্রে বারবার সামনে আসবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
তাইওয়ানের ইয়োয়ান্তা পোলারিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট নামের রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান লিয়ান কুয়ো-ইউয়ান বলেন, তাইওয়ানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রস্তুতির ওপরেই এখন টেরি গোকে মনোযোগ দিতে হবে। তাইওয়ানের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েনের বিরুদ্ধে লড়তে তাঁকে বিরোধী ন্যাশনালিস্ট পার্টি থেকে আগামী মাসে মনোনয়ন নিতে হবে। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে লড়তে ওয়েন ইতিমধ্যে তাঁর দলের মনোনয়ন পেয়েছেন।
লিয়ান বলেন, ফক্সকন অনেকের কাছে হোন হাই নামেও পরিচিত। প্রেসিডেন্ট পদের জন্য টেরি গো মনোনয়ন পেলে প্রতিষ্ঠানের ওপর তাঁর প্রভাব কিছুটা কমবে। তবে নতুন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আসা কর্মকর্তারা কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর কাছে ছুটে যাবেন। অনেক বিষয়ে প্রয়োজনে তাঁর কাছে পরামর্শ চাইবেন। প্রতিষ্ঠানটির নতুন চেয়ারম্যান টেরি গোর অনেক ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
শুক্রবার বার্ষিক সাধারণ সভায় নতুন চেয়ারম্যানের বিষয়টিতে অনুমোদন দেন শেয়ারধারীরা। নতুন চেয়ারম্যান লিউ ইয়াংয়ের পড়াশোনা যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি ইলেকট্রো-ফিজিকস বিষয়ে পড়েছেন এবং তাইওয়ানের হিউলেট প্যাকার্ডে (এইচপি) কাজ করেছেন।
তাইপে টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, টেরি গোর বিশেষ সহকারী হিসেবে লিউ গত বছর ৮কে রেজল্যুশনের ভিডিও ক্যামেরার জন্য অপটিক্যাল সেন্সরে কারিগরি সফলতা অর্জন করেন। এসব সেন্সরের আকার কমাতে তাঁর ভূমিকা রয়েছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে ইয়াংমাইক্রো নামে একটি মাদারবোর্ড কোম্পানি খুলেছিলেন লিউ। ১৯৯৪ সালে তা ফক্সকনের কাছে বিক্রি করে দেন। যুক্তরাষ্ট্রে কাজের অভিজ্ঞতাই তাঁকে চেয়ারম্যান হিসেবে এগিয়ে রেখেছে।
ফক্সকনে সাড়ে চার দশক ধরে প্রধান হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা টেরি গোকে কঠোর বস ও অক্লান্ত পরিশ্রমী হিসেবে সম্মান এনে দিয়েছে। সব মিলিয়ে নিজে ৬৬০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পদ অর্জন করেছেন। চীনের নয়টি শহরে ১২টি কারখানা করেছেন তিনি। ভিয়েতনামেও উৎপাদন কারখানা তৈরিতে জোর দিয়েছেন। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনে ডিসপ্লে প্যানেল কারখানা করার পরিকল্পনা করছেন।
গোয়ের পরিবারের কোনো সদস্য অবশ্য তাঁর ব্যবসায় আগ্রহ দেখায়নি। অর্থাৎ ব্যবসায় পরিবারতন্ত্র চালু করেননি তিনি।
গত এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে প্রাথমিক আলোচনার সময় থেকেই বিশ্লেষকেরা বলছেন, নতুন ধারণা গ্রহণ ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার সক্ষমতার জন্য তাইওয়ানের ভোটারদের টানতে পারবেন টেরি গো। এর বাইরে চীনের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক তাঁর প্রচারে বাড়তি ওজন যুক্ত করবে। চীনের কম পারিশ্রমিকের হাজার হাজার কর্মী তাঁর সফলতার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। তবে তাঁর কারখানার কর্মপরিবেশ ২০১০ সালে বিশ্বব্যাপী নজরে আসে। ওই সময় তাঁর কারখানার কর্মীদের একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। চীনের সঙ্গে টেরি গোর বাণিজ্যিক যোগাযোগও তাইওয়ানের অনেক ভোটারের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে; বিশেষ করে যাঁরা তাইওয়ানকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে একীভূত করতে বেইজিংয়ের লক্ষ্যের বিরোধিতা করেন।
হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে তাইওয়ানের শীর্ষ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ছিলেন হোন হাই প্রিসিসনের চেয়ারম্যান টেরি গো।
তাইপে টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, টেরি গোকে মূলত ‘কাজপাগল’ হিসেবেই চেনেন অনেকে। তাঁর পরিকল্পনার মূলেই থাকে প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা বাড়ানোর বিষয়টি। অধ্যবসায় ও আত্মশাসনের মধ্য দিয়েই তিনি এত দিন ধরে প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তুলেছেন। তিনি তাঁর ১ লাখ ১৪ হাজার কর্মীকে নিয়ে গড়া প্রতিষ্ঠানে শক্তিশালী ও সামরিক বাহিনীর মতো কাজের নৈতিকতা আরোপ করেছেন। তাঁর সন্তানেরা প্রতিষ্ঠানে আগ্রহ দেখাননি। অথবা তাঁদের ব্যবসায় আনার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করেননি তিনি। ২০০০ সালে প্রথম স্ত্রী সেরেনা লিনকে নিয়ে শিক্ষামূলক একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান খোলেন টেরি গো। ২০০৫ সালে লিন স্তন ক্যানসারে মারা যান। টেরি গো তখন তাইওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োমেডিক্যাল গবেষণা প্রকল্প ও ৫০০ শয্যার ক্যানসার হাসপাতালে প্রায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার দান করার ঘোষণা দেন। এ ছাড়া তিনি তাঁর মোট সম্পদের ৯০ শতাংশ জীবনের যেকোনো সময়ে দাতব্যকাজে ব্যয় করার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন।