যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধে 'ভয়াবহ' বিপদে অ্যাপল?
হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রথম ইটটি ছুড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এবার চীনের পাটকেল ছোড়ার পালা। আর এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে টেকজায়ান্ট অ্যাপল। চীন যদি বদলা নিতে শুরু করে, তবে সবার আগে বেকায়দায় পড়বে অ্যাপল। আইফোনের নির্মাতা কি তবে বিপদে পড়তে যাচ্ছে?
অ্যাপলের শুরুর দিকে কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস আমেরিকাতেই পণ্য উৎপাদন করতে চেয়েছিলেন। ম্যাকিনটোশ কম্পিউটার উৎপাদনের জন্য নিজের দেশেই কারখানা খুলতে চেয়েছিলেন জবস। কিন্তু তাতে পণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে ফেলছিল। অ্যাপলের বর্তমান প্রধান টিম কুক প্রতিষ্ঠার বেশ কিছুদিন পর অ্যাপলে যোগ দেন। যোগ দিয়েই কোম্পানির সাপ্লাই চেইনে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন তিনি। অ্যাপলের পুরো উৎপাদনব্যবস্থা ধীরে ধীরে চীননির্ভর হয়ে ওঠে। সস্তা শ্রমের সুবিধা দিয়ে এত দিন চীনই অ্যাপলকে মুনাফা অর্জনের রাস্তা দেখিয়ে আসছিল। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক সিদ্ধান্তেই সেই প্রতিষ্ঠিত সাপ্লাই চেইন এখন নষ্ট হওয়ার জোগাড়।
শুধু পণ্য উৎপাদনের জন্যই চীনের ওপর অ্যাপল নির্ভরশীল—বিষয়টি এত সরল নয়। চীনের বিশাল ভোক্তাগোষ্ঠী অ্যাপলের তৃতীয় বৃহত্তম বাজার। অ্যাপলের বৈশ্বিক বিক্রির ১৯ শতাংশ হয় চীনে। সুতরাং চীনের বাজারে আইফোন বিক্রি কমে যাওয়ার অর্থ হলো, অ্যাপলের পুরো লাভের অঙ্ক কমে যাওয়া। মার্কিন ম্যাগাজিন ‘ওয়্যারড’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের শুরুতে চীনের স্মার্টফোনের বাজারের ১০ শতাংশ ছিল আইফোনের দখলে। এখন তা ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। চীনে প্রায় সব প্রতিষ্ঠিত স্মার্টফোন কোম্পানির ব্যবসাতেই ধস নেমেছে। ব্যতিক্রম শুধু হুয়াওয়ে। এই কোম্পানির বিক্রিই শুধু বেড়েছে।
‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হুয়াওয়ের ওপর আরোপ করা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা চীনে ব্যাপক জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে। চীনের মানুষ আমেরিকার আনা গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগকে আমলেই নিচ্ছে না। বরং মনে করছে, ক্রমেই উন্নতি করা হুয়াওয়কে ঠেকিয়ে নিজেদের বাজার বাঁচাতেই অন্যায্যভাবে হুয়াওয়েকে কোণঠাসা করছে আমেরিকা। এই মনোভাব তৈরিতে চীনা সরকারের ভূমিকাও কম নয়। শোধ নিতে চীনের নাগরিকেরা এখন হাতের কাছে পাচ্ছেন মার্কিন প্রতিষ্ঠান অ্যাপলকে। তাই চীনে বিক্রি কমে যাচ্ছে আইফোনের, আর সুবিধাজনক অবস্থায় চলে যাচ্ছে হুয়াওয়ে। ওদিকে সিটি ব্যাংকের এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) চীনে আইফোনের বিক্রির পরিমাণ দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল থেকে জুন) অর্ধেকে নেমে আসতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসন গত ১৫ মে হুয়াওয়েকে যুক্তরাষ্ট্রে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করে। সরকারি অনুমোদন ছাড়া মার্কিন সংস্থা থেকে প্রযুক্তিসেবা নেওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায় হুয়াওয়ের। এরপরই অবশ্য এই বিধিনিষেধ ৯০ দিনের জন্য শিথিল করে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগ। মোবাইল চিপ থেকে শুরু করে সফটওয়্যার পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে হুয়াওয়ে নানা মার্কিন প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। এগুলোর মধ্যে আছে গুগল, মাইক্রোসফট, এআরএম, প্যানাসনিকসহ আরও অনেক কোম্পানি। এসব কোম্পানি এখনো হুয়াওয়েকে সেবা দিচ্ছে বটে। কিন্তু তিন মাসের মেয়াদ শেষ হলে এবং নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বলছে, প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ আছে চীনেরও। কোপ পড়লে তা প্রথমেই পড়বে অ্যাপলের ওপর। কারণ অ্যাপলের পণ্য উৎপাদিত হয় মূলত চীনে। পণ্যের গায়ে লেখা থাকে, ‘ডিজাইনড বাই অ্যাপল ইন ক্যালিফোর্নিয়া, অ্যাসেম্বলড ইন চায়না।’ চীনে পণ্য সংযোজনের পাশাপাশি অ্যাপলের বিভিন্ন সফটওয়্যার বা অ্যাপ্লিকেশনের কাজও হয়। প্রায় ২৫ লাখ চীনা সফটওয়্যার প্রকৌশলী এ নিয়ে কাজ করে থাকেন। আর পণ্য সংযোজনে কাজ করেন প্রায় ১৫ লাখ চীনা কর্মী। ফলে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার—দুই দিক থেকেই চীনের ওপর নির্ভরশীল স্টিভ জবসের প্রতিষ্ঠান। এখন চীন যদি প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কর হার বাড়িয়ে দেয়, তবে অ্যাপলের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। মরগান স্ট্যানলি ব্যাংক বলছে, সে ক্ষেত্রে ৯৯৯ ডলার বাজারমূল্যের একটি নতুন আইফোন বানাতে খরচ বেড়ে যাবে ১৬০ ডলার। অ্যাপল এই বাড়তি খরচ ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিক অথবা নিজে বহন করুক—দুই ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানটির মোট মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
চীনের বাইরে ভারতেও আইফোন উৎপাদন করছে অ্যাপল। তবে তা চীনকে টেক্কা দেওয়ার মতো নয়। জাপানের প্রকাশনা নিক্কেই এশিয়ান রিভিউ বলছে, অ্যাপলের শীর্ষস্থানীয় ২০০ সরবরাহকারীর মধ্যে মার্কিনদের তুলনায় চীনাদের আধিক্য বেশি। গত বছরের হিসাবে দেখা গেছে, অ্যাপলে চীনের ৪১ সরবরাহকারী রয়েছেন। আর আমেরিকা থেকে সরবরাহকারীর সংখ্যা ৩৭।
চীন এরই মধ্যে গত শুক্রবার এক সতর্কবার্তা দিয়েছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোকে। ওই বার্তায় চীনা কর্তৃপক্ষ বলেছে, অবিশ্বস্ত বিদেশি সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির তালিকা করেছে তারা। অন্যদিকে সাইবার সিকিউরিটি আইনের খসড়া করে ফেলেছে সি চিন পিংয়ের সরকার। এই আইনের আওতায় জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে চীন। কন্ট্রোল রিস্কস নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা অ্যান্ড্রু গিলহোম বলছেন, যেসব মার্কিন প্রতিষ্ঠান চীনে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাদের প্রতি খড়গহস্ত হতে সি চিন পিংয়ের সরকার এই আইন ব্যবহার করতে পারে।
‘ওয়াল স্ট্রিট’-এর বিশ্লেষকেরা অবশ্য বলছেন, অ্যাপলকে বিপদে ফেললে ক্ষতি হবে চীনেরও। যদি অ্যাপল নিজেদের গুটিয়ে নেয়, তবে চীনা সফটওয়্যার প্রকৌশলীসহ অন্য কর্মীরা বেকার হয়ে পড়বেন। চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এমনকি তাতে ধসও নামতে পারে। কারণ চীনের অর্থনীতিতে প্রতিবছর অ্যাপল যে অবদান রাখে তা নেহাত কম নয়, প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার।
এক কথায়, চীনের হুমকি থেকে বাঁচতে বিকল্প সাপ্লাই চেইন তৈরি করা ছাড়া বাঁচার উপায় নেই অ্যাপলের। আর সেটি করাও চাট্টিখানি কথা নয়। এর জন্য যথেষ্ট সময় প্রয়োজন। অনেকে ধারণা করছেন, আমেরিকা ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ থামাতে ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হতে পারেন অ্যাপল-প্রধান টিম কুক। এই দুই দেশের মধ্যে দূতিয়ালির অভিজ্ঞতাও নাকি কুকের আছে। নিজের ঘর পুড়তে শুরু করলে এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী!