প্রযুক্তির হাতেই সে দক্ষতা

অনলাইনে শিক্ষা। প্রতীকী ছবি।
অনলাইনে শিক্ষা। প্রতীকী ছবি।

শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। প্রযুক্তির যতই উন্নয়ন হোক, ভালো শিক্ষকের গুরুত্ব সব সময় রয়েছে। বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোয় কার্যকরী শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে শিক্ষকের গুরুত্ব অনেক বেশি। কিন্তু একাধারে শুধু শিক্ষার্থীদের হাতে স্মার্টফোন-ট্যাব-ল্যাপটপ ধরিয়ে দিলেই কি শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত হয়ে যাবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের হাতে ডিজিটাল যন্ত্র তুলে দেওয়ার আগে শিক্ষকদের বিষয়েও নজর দেওয়া দরকার। 

ইকোনমিস্টের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরিদ্র দেশগুলোয় অদক্ষ শিক্ষকদের দক্ষ করে তুলতে পারে প্রযুক্তি। এর বাইরে ক্লাসে শিক্ষকদের অনুপস্থিতি ঠেকাতেও প্রযুক্তি সাহায্য করতে পারে। শিক্ষা খাতে প্রযুক্তির সমন্বয় করতে পারলে লাভের পাল্লাই বেশি ভারী হবে।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯১৩ সালে টমাস এডিসন বলেছিলেন, শিগগিরই স্কুল থেকে বই হারিয়ে যাবে। এর জায়গা নেবে নির্বাক ছবি। যখনই রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটারের মতো তথ্যপ্রযুক্তির নতুন ঢেউ উঠেছে, তখনই এ ধরনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই পুরোনো সেই বই, শ্রেণিকক্ষ আর শিক্ষকেরা আশ্চর্যভাবে টিকে গেছেন। শিক্ষকের মতোই ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা নানা রকমভাবে গৃহীত হয়েছে। প্রচলিত শিক্ষার সঙ্গেই যদি ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থাকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করা যায়, তবে দরিদ্র দেশগুলোর স্কুলগুলোয় তা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। কারণ, এসব জায়গায় অনেক শিক্ষকের বিষয় সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকে না বা অনেকই ঠিকমতো ক্লাসে হাজির হন না।

জাতিসংঘের সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ছিল ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বের সব শিশু প্রাথমিক শিক্ষা পাবে। এ লক্ষ্যের বিশাল অংশ পূরণ করা গেছে। এখন প্রতি দশটির মধ্যে নয়টি শিশু স্কুলে ভর্তি হয়। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হওয়া আর সেখান থেকে ঠিকমতো শিক্ষা পাওয়া কি এক কথা? বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, আফ্রিকার দেশগুলোয় নয় বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে অর্ধেকের কাছাকাছি শিশু একটি সহজ শব্দ পড়তে পারে না। এক-তৃতীয়াংশ শিশু একটি সহজ বাক্য পড়তে পারে না। এর কারণ কী? এর কারণ হচ্ছে যথাযথ শিক্ষার অভাব। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ৭ শতাংশের কাছাকাছি শিক্ষকের কার্যকরভাবে পড়া ও লেখার নির্দেশনা দেওয়ার সামান্য জ্ঞান আছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষকের বেতন-ভাতা বাড়ালে বা বেশি অর্থ দিলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? না। অনেক দরিদ্র দেশে শিক্ষকের বেতন স্থানীয় অনেকের আয়ের তুলনায় বেশি। তাঁদের বেতন কম-বেশির সঙ্গে যথাযথ পড়ালেখা শেখানোর সম্পর্ক নেই। ২০০৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর পরেও কোনো প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। এর বাইরে শিক্ষকদের অনুপস্থিতির একটি বিষয়ও রয়েছে। বেতন বেশি পাওয়া শিক্ষকেরা যদি ক্লাস না নেন, তবে কি সরকার তাঁদের বাদ দেবে? এটা বলা সহজ হলেও করা কঠিন। শিক্ষক ক্লাসে উপস্থিত হচ্ছেন কি না, তা অনেক সময় সরকারের পক্ষে নজরদারি করা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া শিক্ষকদের জোট বা খুঁটির জোর থাকে। তাই ক্লাস না নিয়েও অনেক শিক্ষকের চাকরি নিরাপদ।

এখানেই শিক্ষা খাতের ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের আসল কারিশমা। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় দরিদ্র দেশগুলোর উন্নতি বেশি। কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ছোট আকারের ক্লাসরুম, পুষ্টি সরবরাহ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য সুবিধার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষাপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ওপর সম্পদের যথাযথ বিনিয়োগ করলে সুফল বেশি। অবশ্য এর মানে এই নয় যে স্কুলে কম্পিউটার বা প্রযুক্তিপণ্য দিয়ে ভর্তি করে ফেললে সুফল আসবে। বরং এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। স্কুলে কম্পিউটার দিলেই শিক্ষার্থীরা তা চালানো শিখে যাবে—এ কথা ভাবলে শুধু টাকার শ্রাদ্ধই হবে। এর পরিবর্তে স্কুলগুলোকে শিক্ষার্থীবান্ধব যথাযথ সফটওয়্যার সরবরাহ করলে বেশি উপকার পাওয়া যাবে। কোনো শিক্ষক বা সহকারীর সামান্য সাহায্য নিয়ে যদি শিক্ষার্থীরা ওই সফটওয়্যার চালানো শেখে এবং কোনো কাজ যথাযথভাবে করতে পারে, তবে যথার্থ শেখা হবে। এতে শিক্ষার্থীর সক্ষমতা বাড়ে। এ ছাড়া শিক্ষক কোনটি শেখাবেন এবং ক্লাসরুমে কী ঘটবে, তা কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা করতে পারবে। এ ছাড়া ক্লাসে শিক্ষকের উপস্থিতিও পরীক্ষা করা যাবে এতে।

অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, দুর্গম ও দরিদ্র এলাকার স্কুলগুলোয় শিক্ষাপ্রযুক্তির যথাযথ অবকাঠামো কোথায় পাওয়া যাবে? কিন্তু বিবেচনা করতে হবে আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোর মতোই অনেক দেশে দ্রুত বিদ্যুৎ–সুবিধা বাড়ছে। বিদ্যুৎ–সুবিধার পাশাপাশি অনেক এলাকায় সৌরবিদ্যুৎও পৌঁছে গেছে। তাই সব স্কুলে ইন্টারনেট থাকতে হবে—এমন কথা নেই। যেখানে ইন্টারনেট আছে, সেখানে ডিভাইস একবার নিয়ে গিয়ে কনটেন্ট ডাউনলোড বা আপলোড করে আনলেই হলো। এ ক্ষেত্রে খরচ কিন্তু খুব বেশি নয়।

কেনিয়ায় এমনই একটি স্কিম বা কর্মসূচি চালু আছে। এ স্কিমের নাম ‘তুসাম’। কিসওয়াহিলিতে যার অর্থ ‘চলো পড়ি’। সফল ও স্কিমে প্রতিবছরে শিশুপ্রতি চার মার্কিন ডলার খরচ হয়। সেখানকার সরকারি স্কুলগুলোয় এ স্কিম চালু হয়েছে। এ কর্মসূচির সফলতা দেখে বলা যায়, শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা ও প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন আসল কথা।

একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, প্রযুক্তি সব রোগের ওষুধ নয়। এখনো দক্ষ শিক্ষকের প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষকের মাধ্যমে প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতি দ্রুত বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তাই কর্তৃপক্ষকে শিক্ষকদের গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁদের জন্য শিক্ষাসহায়ক প্রযুক্তি যুক্ত করতে হবে। এতেই কেবল শিক্ষার বারোটা বাজা ঠেকানো যাবে।