মতিউর মুন্নার সেই 'স্বর্ণালি' স্মৃতি
এক যুগ আগের সেই শীতের রাতটি হয়তো কোনো দিনই ভুলতে পারবেন না এদেশের ফুটবলপ্রেমীরা। হিম ছড়ানো সেই রাতটি যে ভাসিয়েছিল অনাবিল এক আনন্দে।
২০০৩ সালের সেই শীতের রাতে ভারতকে হারিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভরিয়ে তোলা দর্শকেরা সাক্ষী হয়েছিলেন এক সোনালি স্মৃতির। মতিউর মুন্নার এক ‘সোনালি গোল’ শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছিল ২-১ গোলের জয়।
ফুটবলে তখন ‘গোল্ডেন গোল’ যুগ। পরীক্ষামূলকভাবে চালু ফিফার যে নিয়ম অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ের খেলা অমীমাংসিত থাকলে অতিরিক্ত সময়ে প্রথম গোল করা দলটিই জিতে যেত। ২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেই সেমিফাইনালের নিষ্পত্তি হয়েছিল মতিউর মুন্নার গোল্ডেন গোলে। গোল্ডেন গোলে জেতা বাংলাদেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক ম্যাচও এটিই।
অস্ট্রিয়ান কোচ জর্জ কোটানের অধীনে ঘরের মাঠে ২০০৩ সালের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপটা দুর্দান্তই খেলেছিল বাংলাদেশ। অনেকের মতে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটিই বাংলাদেশের সেরা পারফরম্যান্স। অধিনায়ক ছিলেন রজনীকান্ত বর্মণ। সঙ্গে আমিনুল হক, আলফাজ আহমেদ, আরিফ খান জয়, হাসান আল মামুন, আরমান মিয়া, মোহাম্মদ সুজন, নজরুল ইসলাম, ফিরোজ মাহমুদ টিটু, রোকনুজ্জামান কাঞ্চন, মতিউর মুন্নাদের নিয়ে গড়া বাংলাদেশ গ্রুপ পর্যায়ে নেপাল ও মালদ্বীপকে হারিয়েছিল ১-০ গোলে, ৩-০ গোলে ভুটানকে। সেমিফাইনালে বাংলাদেশের সামনে শক্তিশালী ভারত। যেটিতে মতিউর মুন্নার অবিস্মরণীয় ওই গোল। এখন পর্যন্ত ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বশেষ জয়ও হয়ে আছে এটিই।
সে ম্যাচের নায়ক মতিউর মুন্নাকে আজও নাড়া দেয় সেই দিনটি। নির্ধারিত সময়ে খেলা ১-১ গোলে শেষ হওয়ার পর অতিরিক্ত সময়ের ৮ মিনিটে মুন্নার ওই গোল। প্রায় মাঝমাঠে প্রতিপক্ষের পা থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে বাঁ দিক দিয়ে দ্রুতবেগে প্রতিপক্ষের সীমানায় ঢুকে প্রায় ২০ গজ দূর থেকে শট। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামকে উত্তাল করে তা ঠাঁই নেয় গোলে। সেই স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মুন্নার কণ্ঠে শিহরণ, ‘পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে আজও অবিশ্বাস্য মনে হয়। ভারতের এক মধ্যমাঠের খেলোয়াড়ের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে খুব দ্রুতই তাদের ডি বক্সের কাছাকাছি পৌঁছে যাই। সেখান থেকে বলটি দলের অন্য কাউকেও দিতে পারতাম। কিন্তু কী মনে করে গোলপোস্ট লক্ষ্য করেই শট নিয়ে নিলাম। বলটা যখন জাল স্পর্শ করল, তখন আমি আনন্দে আত্মহারা। লম্বা একটা দৌড় দিয়েছিলাম, এটা মনে আছে। তবে আনন্দের আতিশয্যে কী কী করেছি, এত বছর পর তা মনে নেই। সবচেয়ে বড় কথা, আমার গোলে সেদিন ভারতকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ।’
জর্জ কোটানের ৩-৫-২ পদ্ধতিতে সাজানো কৌশলে সেদিন ভারতের বিপক্ষে দারুণ খেলেছিল বাংলাদেশ। দুই উইংয়ে হাসান আল মামুন ও মোস্তফা আনোয়ার পারভেজ ওভারল্যাপ করে আক্রমণে সহায়তা করছিলেন। মাঝমাঠ থেকে আরমান তৈরি করছিলেন একের পর এক আক্রমণ। গোলপোস্টের নিচে আমিনুল দাঁড়িয়েছিলেন প্রাচীর হয়ে।
ম্যাচের ৭৭ মিনিটে আরমান মিয়ার কর্নার থেকে দারুণ এক হেডে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছিলেন রোকনুজ্জামান কাঞ্চন। পুরো স্টেডিয়াম তখন ভারতকে হারানোর স্বপ্ন পূরণের আনন্দে অধীর। কিন্তু যা হয় আরকি! ক্ষণিকের মনোযোগহীনতার খেসারত দিয়ে গোল খেয়ে বসল বাংলাদেশ। ৮১ মিনিটে ম্যাচে সমতা ফিরিয়ে আনলেন ভারতের আলভিটো ডি সুজা।
অতিরিক্ত সময়ে গড়াল খেলা। স্টেডিয়াম তখন কাঁপছে উত্তেজনায়। কিছুটা উৎকণ্ঠাতেও। অনেকের মনে ফিরে আসছিল ১৯৮৫ সাফ গেমসের ফাইনাল। যেটিতে ভারতের কাছে টাইব্রেকারে হারতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। ১৯৯৫ সালের সার্ক গোল্ডকাপেও ভারতের বিপক্ষে টাইব্রেকারে হেরেছিল বাংলাদেশ। টাইব্রেকার নিয়ে ভীতিটা তাই স্বাভাবিকই ছিল।
সেই ভীতিকে উড়িয়ে দিয়েছিল মতিউর মুন্নার ওই ‘সোনালি গোল’। পুরো দেশকে রাঙিয়ে দিয়েছিল আনন্দের রঙে।
কোনো কোনো স্মৃতি চিরদিনই অমলিন থেকে যায়। মতিউর মুন্নার গোলটিও এ দেশের ফুটবলে এমনই এক হিরণ্ময় স্মৃতি।