বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাচ্ছে আজই। সুপার টেনে খেলার লক্ষ্য পূরণ হলেও স্মৃতির পাতায় ঘরের মাঠের এই বিশ্বকাপ হয়ে থাকবে হতাশার স্মারক। আর সবার মতো দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসানও তাতে জ্বলেছেন নিবু নিবু হয়ে। কাল হোটেল সোনারগাঁওয়ের সুইমিংপুলের পাড়ে বসে সেসব নিয়েই কথা বলেছেন বাংলাদেশের এই অলরাউন্ডার—
নিজেদের দেশে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বাংলাদেশের জন্য হতাশাজনকই হলো। তো ফলাফল এত খারাপ হওয়ার কারণ কী মনে হয়?
সাকিব: অনেক কিছুই। মানুষের প্রত্যাশা, সাংবাদিকদের লেখালেখি...বোর্ডের চাপও একটা ব্যাপার। এত চাপে খেলোয়াড়েরা বিভ্রান্ত হয়ে যায়। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে। একজন খেলোয়াড় যখন জানে যে খারাপ করলে বাদ পড়ে যাবে, সে তখন দলের কথা কম চিন্তা করে শুধু নিজের কথাই ভাবে। দলের চার-পাঁচজন যখন এভাবে চিন্তা শুরু করে, বাকিদের মধ্যেও প্রভাব পড়ে। তখন না কোচ কোচের সেরা কাজটা করতে পারে, না অধিনায়ক অধিনায়কের সেরা সিদ্ধান্তটা নিতে পারে, না খেলোয়াড়েরা সেরা পারফরম্যান্স করতে পারে।
দেশের মাটিতে খেলাটা কি তাহলে আশীর্বাদের বদলে শুধুই চাপ?
সাকিব: সবচেয়ে ভালো দেশের বাইরে খেলা। দুই বছর দেশে খেলা না হোক। দেশের মানুষের প্রত্যাশা কমে যাক, তাহলে ভালো হবে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রত্যাশার সীমাটা কোন পর্যায়ের হওয়া উচিত, এটা আমাদের বোঝা উচিত। হ্যাঁ, আমরা যখন ও রকম খেলোয়াড় তৈরি করব, তখন আমরা বলতে পারব। কিন্তু আমাদের পাইপলাইনে না আছে ও রকম খেলোয়াড়, না আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের মান অত ভালো, না আমাদের অনুশীলন-সুবিধা ভালো, না আমাদের কোচিং স্টাফ ও রকম বিশ্বমানের। আমরা যারা হয়ে গেছি, যতটুকু হয়েছি ততটুকুই। হয়তো নিজেদের পরিশ্রমে, কয়েকজনের চেষ্টায় আমরা কয়েকজন এই পর্যায়ে এসে গেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমরা কেউ কেউ হয়তো একটু উন্নতি করতে পারব, কিন্তু দল হিসেবে খুব বেশি এগোব কি না তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। টেস্টে আমাদের রানের গড় ৪০-৪৫ হতে হবে। সে জন্য তো খেলোয়াড় লাগবে।
সুপার টেনে টানা তিন ম্যাচেই তো হতাশাজনক হার। প্রতিপক্ষ দলগুলোর চেয়ে ঠিক কোথায় আপনারা পিছিয়ে?
সাকিব: আপনিই বলুন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে কোন দিক থেকে আমাদের এগিয়ে রাখবেন? পাকিস্তানের চেয়ে কোন দিক থেকে আমরা এগিয়ে! কিংবা ভারত—এ রকম একেকটা দল যদি এক শতে এক শ হয়, আমরা তো আশিও না! সর্বোচ্চ চল্লিশ-পঞ্চাশ হব। তাহলে বোঝেন, ওদের সঙ্গে জিততে আমাদের কী পরিমাণ ভালো খেলতে হবে। আর এটা তো দ্বিপাক্ষিক সিরিজ না, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সবাই তো সর্বোচ্চ চেষ্টাই করবে। টি-টোয়েন্টিতে দক্ষতা যেমন দরকার, শক্তিরও দরকার আছে। দুটিই না থাকলে আপনি পারবেন না। টি-টোয়েন্টির জন্য সবচেয়ে বেশি টাকা পায় কারা? গেইল, ডি ভিলিয়ার্স—কী পাওয়ার ওদের খেলায়! জাতিগতভাবেই আমরা শারীরিকভাবে ওদের চেয়ে পিছিয়ে। জন্মের পর থেকে আমরা খাই সবজি খিচুড়ি...নরম করে রান্না করা। এই তো আমাদের খাওয়া, তাই না! আর ওরা ছোটবেলা থেকে অরেঞ্জ জুস খায়। আমাদের হয়তো পাঁচ-দশ ভাগ শিশু এই খাওয়াটা পায়। আমাদের তো ওই সামর্থ্যটা নেই। আর খাওয়াবেন কী, তা-ও তো ভেজাল। আপনি অরেঞ্জ জুস খাওয়াবেন? ফরমালিনে ভরা। বাংলাদেশে নাকি তিনটা ফলে সবচেয়ে বেশি ফরমালিন। কমলা, আপেল আর মাল্টা। যে তিনটা ফল বেশি খাওয়া উচিত, সেগুলোই বাংলাদেশে খাওয়া যায় না।
সার্বিকভাবে ক্রিকেটের উন্নতিটা যে এক জায়গায় থমকে যাচ্ছে, সে দায়টা কার?
সাকিব: ক্রিকেট-সংশ্লিষ্ট সবারই...সেটা নির্বাচক বলেন, কোচ বলেন, বোর্ড সভাপতি বলেন, বোর্ড সদস্য বলেন বা আমরা খেলোয়াড়দের। সবারই নিজেদের জায়গা থেকে কিছু করার আছে। নির্দিষ্ট কাউকে দায়ী করা যাবে না। সব জায়গা যখন ঠিক হবে, তখন আমাদের দলটাও ভালো হবে। এই বিশ্বকাপ যা হওয়ার হয়েছে। এখন ২০১৫ বিশ্বকাপের প্রতি আমাদের অনেক বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। ওখানে খারাপ খেললে খুব বড়সড় সমস্যা হয়ে যেতে পারে। আসলে ওই বিশ্বকাপই তো মানুষ মনে রাখে।
তার পরও যদি প্রশ্ন করি, দায়বদ্ধতার জায়গায় কি খেলোয়াড়েরা ঠিক আছেন?
সাকিব: পারফর্ম না করলে দায়দায়িত্ব অবশ্যই খেলোয়াড়দের। আমি দুই ম্যাচে রান করিনি, ওটার দায়িত্ব আমারই। অনেককে বলতে শুনি, ‘আমাকে নিয়ে এত কথা কেন! আমি এত দিন ভালো খেললাম...।’ আমি বলি, আমাদের কাজই ভালো খেলা। সমালোচনাটাকে এমনভাবে নেওয়া উচিত যে ঠিক আছে মানুষ খারাপ বলছে, বলুক। আমার একটাই রাস্তা আছে জবাব দেওয়ার—হয় ব্যাটে রান করো, নয় বলে উইকেট নাও। তবে খেলোয়াড়ের খারাপ সময়ে বেশি নেতিবাচক কথা না বলাই ভালো। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আমাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা শুরু হয়ে যায়। এটা খুবই খারাপ। সবারই ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু আছে। খারাপ খেললে খেলা নিয়ে যত পারেন লেখেন, বলেন। কিন্তু আমার মনে হয় না কখনো কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আক্রমণ করা উচিত।
বাংলাদেশের বিবেচনায় ক্রিকেটারদের আয় অনেক বেশি। খারাপ খেললে এটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা কি স্বাভাবিক নয়?
সাকিব: আমি দেশকে কী দিচ্ছি আর দেশ আমাকে কী দিচ্ছে—আমার মনে হয় না এই চিন্তা কারও মধ্যে কখনো আসে। দেশ আমাকে যা দিয়েছে...সবচেয়ে বড় কথা এই নামটা যে দিয়েছে, এই নাম কোনো দিন কেউ আমাকে দিতে পারত না। এখানেই কথা শেষ। আমি যা-ই দিই, দেশের ঋণ কখনো শোধ হবে না। আর আয়ের কথা যে বললেন, জাতীয় দলের একটা ক্রিকেটারকে যে মান মেনে চলতে হয়...বললে হয়তো খারাপ শোনা যাবে, আমার বেতন কোন দিক দিয়ে আসে কোন দিক দিয়ে যায় আমি জানি না। একটা ভালো রেস্টুরেন্টে যান, পাঁচ-ছয়জন লাঞ্চ করেন, ডিনার করেন, আপনার ২০-২৫ হাজার টাকা শেষ।
ক্রিকেটারদের দেশাত্মবোধ নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তোলে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
সাকিব: খেলার সময় দলের জন্য সবাই জানপ্রাণ দিয়েই চেষ্টা করে। দেশপ্রেম কার মধ্যে কতটুকু আছে জানি না, তবে দলের প্রতি ভালোবাসা সবার আছে। আর যদি দেশপ্রেমের কথা বলি, বাংলাদেশের অনেক মানুষের মধ্যেই সেটা নেই। অনেকেই মুখে অনেক কথা বলতে পারে। কিন্তু যদি তাকে একটা চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন, যখন আপনি প্রমাণ করতে বলবেন দেশপ্রেম আছে কি নেই, তখন দেখবেন ৯০ শতাংশ লোক সরে গেছে।
সাকিব আল হাসানের কাছে প্রত্যাশা সব সময়ই পাহাড়সম। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তার কতটা পূরণ করতে পারলেন?
সাকিব: যদি প্রথম তিন ম্যাচের কথা চিন্তা করি, আমি খুব ভালো করেছি। জানি না কে কীভাবে নেবে, আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় যদি আমি হংকংয়ের সঙ্গে বোলিংয়ে ৩ উইকেট আর ব্যাটিংয়ে ৩৪ রান না করতাম বাংলাদেশের সুপার টেনে আসা হতো না। আমি ধারাবাহিক থাকতে চেয়েছিলাম, দুটি ম্যাচে হয়নি। টি-টোয়েন্টিতে এটা হতেই পারে। আর বোলিংয়ের কথা বলব আমি অমন বোলার না যে ৫ উইকেট নিয়ে প্রতিদিন ম্যাচ জিতিয়ে দেব। কোনো দিনই ওই বোলার ছিলাম না, এখনো নই, হবও না। আমি সাঈদ আজমলও না, সুনীল নারাইনও না, যে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারব। হ্যাঁ, আমি এমন বোলার যে, দলের জন্য একটা ভালো ওভার দরকার, ওটা করে দিতে পারব। উইকেট নিব, সেই গ্যারান্টি দিতে পারব না। শেষ ওভারে ১০-১২ রান লাগবে, তখন যদি আমাকে বোলিং দেয় আমার আত্মবিশ্বাস আছে যে, আমি জিতিয়ে দিতে পারব। আর একটা ম্যাচ আছে। যদি ভালোভাবে শেষ করতে পারি, তাহলেই ভাবব আমার জন্য ভালো একটা বিশ্বকাপ গেল।
শ্রীলঙ্কা সিরিজে ক্যামেরার সামনে অশোভন ভঙ্গি করে বহিষ্কার হয়েছিলেন। ওই ঘটনা নিয়ে কি আপনি এখন অনুতপ্ত?
সাকিব: প্রথম কথা হলো, আমি কাউকে হেয় করার উদ্দেশে কিছু করিনি। যে ক্যামেরাম্যান সামনে ছিল, উনি বাঙালি, আমার পরিচিত। আমার কাছে মনে হয়েছিল উনি ক্যামেরা নামিয়ে রেখে আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করছেন। আমিও তখন দুষ্টুমি করে এটা করি। তবে আমার যত দূর ধারণা, মাঠের অন্যদিকের ক্যামেরাটাও আমার দিকে ধরে রেখেছিল। এটা তো আর আমি জানতাম না। এ রকম হয়ে থাকলে আমার কিছু করার নেই। কারণ আমি বুঝিনি ওখানে ক্যামেরা আছে। বুঝলে কোনো দিনও করতাম না।
ঘরের মাঠে বাংলাদেশ ভালো করল না। এটা নিয়ে আফসোস আছে?
সাকিব: আমার ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার আগে তো আর বাংলাদেশে বিশ্বকাপ হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। সেদিক দিয়ে আরেকটু ভালো করলে তো অবশ্যই ভালো লাগত। কে না চায় ভালো করতে! তবে মাঝেমধ্যে আমার মনে হয়, শ্রীলঙ্কা যে ১৯৯৬ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ওটার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ওদের কাছে দেশের মানুষের কোনো প্রত্যাশা ছিল না। ওরা মাঠে গিয়ে খেলাটা উপভোগ করত। আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ও রকম হলে আমরা হয়তো আরেকটু ভালো পারফর্ম করতে পারতাম।