তাঁদের মাথার মূল্য জানে বার্সা-বায়ার্ন
আর্নেস্তো ভালভার্দে ও নিকো কোভাচ। প্রথমজন বার্সেলোনার কোচ, আরেকজন বায়ার্নের।
একটি জায়গায় বেশ মিল দুজনের। দুজনই কোচ হিসেবে নিজ দলের সমর্থকদের কাছে খুব একটা জনপ্রিয় নন। দুই দল মাঠে খারাপ করলেই ইনিয়ে-বিনিয়ে এ দুজনকেই দোষ দেওয়া হয়। চোখ জুড়ানো ফুটবল খেলান, সে কথা দুজনের হয়ে বলা যায় না। গত তিন বছরে চ্যাম্পিয়নস লিগে বাজেভাবে বাদ পড়া, দলবদলের বাজারে প্রশ্নবিদ্ধ সওদা করা, বিরক্তিকর ফুটবল খেলে প্রত্যাশিত ফল এনে দিতে না পারা—ভালভার্দের বিপক্ষে এসব অভিযোগের শেষ নেই। একই অবস্থা কোভাচেরও। গতবার লিগে অধিকাংশ সময়েই ডর্টমুন্ডের পেছনে ছিলেন, শেষ দিকে এসে ডর্টমুন্ড তাল হারিয়েছিল বলে রক্ষা, না হয় জার্মান লিগটাও জেতা হতো না বায়ার্নের। কোভাচ আসার পর ঘরের বাইরে ইউরোপেও খুব বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় নেই বায়ার্ন।
ফলে এ দুই ভদ্রলোক আলোচিত হন যতটা, সমালোচিত হন তার থেকে কয়েক গুণ বেশি।
তবে যতই সমালোচনা করা হোক না কেন, গত সপ্তাহে ভালভার্দে ও কোভাচ আবারও এক বিন্দুতে এসে মিলেছেন। দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছেন, কোচ হিসেবে তাদের মধ্যে অবশ্যই এমন কিছু আছে, যার ওপর ভরসা করেন বার্সেলোনা ও বায়ার্নের মতো ক্লাবের কর্তাব্যক্তিরা।সেটা কী, ইন্টার ও টটেনহামের বিপক্ষে ম্যাচে দেখিয়েছেন দুজন। নিজ নিজ ম্যাচে দুই কোচের মস্তিষ্কপ্রসূত দুটি সিদ্ধান্ত, যা এনে দিয়েছে জয়।
প্রথমে আসা যাক ভালভার্দের ব্যাপারে। ৪-৩-৩ ছকে ভালভার্দের মিডফিল্ডে ছিলেন সার্জিও বুসকেটস, ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং ও আর্থার মেলো। ওদিকে ৩-৫-২ ছকে ইন্টার কোচ কন্তে মাঝমাঠ সাজিয়েছিলেন কাওয়াদো আসামোয়াহ, স্টেফানো সেনসি, নিকোলো বারেলা, মার্সেলো ব্রোজোভিচ ও আন্তোনিও কানদ্রেভাকে দিয়ে। অর্থাৎ কাগজে-কলমে এমনিতেই বার্সেলোনার তিনজন মিডফিল্ডারের বিপরীতে ইন্টার নেমেছে পাঁচজনকে নিয়ে। দুজন খেলোয়াড় বেশি ইন্টারের মিডফিল্ডে।
এমন অবস্থায় মাঝমাঠের লড়াই জেতার একমাত্র উপায়—যদি নিজেদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও চাপ হজম করে উল্টো প্রতিপক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যায়। বার্সেলোনার মিডফিল্ডে তিনজনের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ না থাকলেও তাঁরা ইন্টারের পাঁচজনের বিপক্ষে কতটুকু কার্যকর—সে প্রশ্ন তোলা যায়। আর সে সুবিধাটাই ম্যাচের শুরু থেকে কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নিয়েছেন ইন্টারের কোচ আন্তোনিও কন্তে।
>গত সপ্তাহে চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজেদের হাইভোল্টেজ ম্যাচ জিতেছে বায়ার্ন মিউনিখ ও বার্সেলোনা । বার্সা ইন্টার মিলানকে হারিয়েছে ২-১ গোলে, ওদিকে টটেনহামের বিপক্ষে বায়ার্নের জয়টা ৭-২ গোলের। এ দুই জয়ের নেপথ্যে কি ছিল?
বার্সেলোনা সব সময় বল নিজেদের দখলে রেখে, আধিপত্য বিস্তার করে খেলতে পছন্দ করে। আক্রমণ করতে পছন্দ করে। সে তুলনায় রক্ষণে বার্সার বড্ড অনীহা। আবার প্রতিপক্ষ বল দখলে রেখে ছোট ছোট পাসে আক্রমণ সাজালেও ঝামেলায় পড়ে যায় দলটি।
কন্তে তা জানতেন। যে কারণে প্রথম থেকেই বার্সেলোনার ওষুধ নিয়ে বার্সেলোনাকেই ঘায়েল করতে চেয়েছেন। বার্সার বিপক্ষে জিততে চাইলে বল নিজেদের দখলে রাখার জন্য চেষ্টা করতে হবে, লম্বা পাস দিয়ে বার্সাকে হারানো যাবে না, বুঝেছে ইন্টার। আর তাই দলের সবচেয়ে দামি স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকুকে না খেলিয়ে এ ম্যাচে আক্রমণভাগে আর্জেন্টিনার স্ট্রাইকার লওতারো মার্টিনেজ ও চিলির অ্যালেক্সিস সানচেজকে খেলিয়েছেন কন্তে, যারা তুলনামূলকভাবে লুকাকুর চেয়ে বল পায়ে বেশি স্বচ্ছন্দ, ছোট ছোট পাসে খেলে বেশি অভ্যস্ত, বল দখলে রাখতে পছন্দ করেন।
প্রথম থেকেই এ কৌশলে খেলেছে ইন্টার। ফলাফল, তৃতীয় মিনিটেই লওতারো মার্টিনেজের গোল। প্রথমেই সফল কন্তের পরিকল্পনা!
আবার মাঝমাঠের আলোচনায় আসা যাক। প্রতিপক্ষ ছোট ছোট পাসে খেলার মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করলে সে চাপ হজম করে উল্টো নিজের জাদু দেখানোর ক্ষমতা এককালে সার্জিও বুসকেটসের ছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এখন আর নেই। এর পেছনে কারণ দুটি। এক—বুসকেটসের বয়স হয়েছে। দুই—আগের মতো গতি নেই তাঁর খেলায়। ফলে ইন্টার মিডফিল্ডের চাপে বুসকেটস বারবার খেই হারিয়ে ফেলছিলেন। প্রতিপক্ষের দুই তরুণ ইতালিয়ান মিডফিল্ডার স্টেফানো সেনসি ও নিকোলো বারেলার আলোকচ্ছটায় ম্লান লাগছিল বুসকেটসকে।
ওদিকে ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং সাধারণত বুসকেটসের জায়গাতেই খেলতে পছন্দ করেন, দুই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারের মাঝে রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে থেকে খেলা নিয়ন্ত্রণ করতে চান। ডি ইয়ং কে সামনে খেলালে তাঁর সম্পূর্ণ কার্যকারিতা পাওয়া যায় না। ফলে দুজনকে একসঙ্গে খেলালে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম।
তিন মিনিটের মাথায় গোল খেয়ে ও প্রথমার্ধের বাকি সময়ে মাঝমাঠে দলের হতাশাজনক খেলা দেখে ভালভার্দে বুঝেছিলেন, বার্সেলোনার মিডফিল্ডে এমন কাউকে লাগবে যে ইন্টারের প্রয়োগ করা চাপ নিষ্ক্রিয় করে উল্টো তাদের ওপর ফেরত দিতে পারবে। সঙ্গে এমন একজনকে লাগবে যে বুসকেটসের কাজটাও ঠিকঠাক করতে পারবে।
কে করবেন এই কাজ? আর্তুরো ভিদাল আছেন না!
দ্বিতীয়ার্ধে বুসকেটসকে তুলে ভিদালকে নামালেন ভালভার্দে। মিডফিল্ডে থেকে প্রতিপক্ষকে চাপ দেওয়ার মাধ্যমে খাটিয়ে মারতে ওস্তাদ এ মিডফিল্ডার উল্টো ইন্টারের ওপরেই চাপ সৃষ্টি করলেন। প্রথমার্ধে দুর্দান্ত খেলা ইন্টার দ্বিতীয়ার্ধে এসে একটু হাঁপিয়েও গিয়েছিল। বুসকেটস নেমে যাওয়ার পর ‘প্রেস’ করার কাজটা শুরু করলেন ভিদাল, আর ওদিকে বুসকেটসের জায়গায় এসে বুসকেটসের কাজ করা শুরু করলেন ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং।
ব্যস, ভালভার্দের টোটকা কাজে লেগে গেল অসাধারণভাবে। সুয়ারেজের প্রথম গোলটার সহায়তা এসেছে ভিদালের পা থেকেই। পরে মেসির সহায়তায় আরও এক গোল করে হারতে থাকা দলকে জিতিয়ে দেন সুয়ারেজ। জয়ের মূল কারিগর কি ভালভার্দেও নন?
ম্যাচ শেষে খোদ লিওনেল মেসি স্বীকার করেছেন ভিদালের অবদানের কথা, ‘আর্তুরো মাঠে আপনাকে সবকিছু দিয়ে সাহায্য করবে। বল কেড়ে নেওয়া থেকে শুরু করে খেলা বানিয়ে দেওয়া, ও একাই সব কাজ করে দিবে। দলের জন্য ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।’
একই ভাবে ম্যাচের মধ্যে নিজের মস্তিষ্কের পূর্ণ ব্যবহার করে দলকে জিতিয়ে এনেছেন বায়ার্ন কোচ নিকো কোভাচও।
টটেনহামের মাঠে বায়ার্ন-টটেনহাম ম্যাচে প্রথম থেকেই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খেলছিলেন স্বাগতিক মিডফিল্ডাররা। বিশেষ করে নতুন আসা ফরাসি মিডফিল্ডার ট্যাঙ্গুয়ে এনদোমবেলে। প্রথমেই গোল করে টটেনহামকে এগিয়ে দেন দক্ষিণ কোরিয়ার ফরোয়ার্ড হিউং মিন সন। কিছুক্ষণ পর বায়ার্নের মিডফিল্ডার জোশুয়া কিমিখ সমতা আনেন ম্যাচে। প্রথমার্ধের একদম শেষ দিকে এসে বায়ার্নকে এগিয়ে দেন বায়ার্নের পোলিশ স্ট্রাইকার রবার্ট লেভানডভস্কি।
প্রথমার্ধ শেষে বায়ার্ন এগিয়ে থাকলেও দলটির কোচ কোভাচ বেশ ভালোই বুঝেছিলেন, নিজের মাঠে টটেনহাম যেভাবে কর্তৃত্ব নিয়ে খেলছে দ্বিতীয়ার্ধে তারা ম্যাচ জিতে গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।
যে কারণে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই লেফটব্যাক ডেভিড আলাবাকে সরিয়ে মাঠে একটা অতিরিক্ত মিডফিল্ডারকে নামান কোভাচ। মাঠে আসেন স্প্যানিশ তারকা থিয়াগো আলকান্ত্রা। এমন না যে আলাবা ম্যাচে বাজে খেলছিলেন। কিন্তু ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দিকে আনার জন্য একজন বাড়তি মিডফিল্ডারের বড্ড প্রয়োজন ছিল বায়ার্নের। এ জন্যই কোরেন্তিন তোলিসো ও জোশুয়া কিমিখের পাশাপাশি মাঠে নামানো হয় আলকান্ত্রাকে।
ভোজবাজির মতো কাজ করে সিদ্ধান্তটা। দ্বিতীয়ার্ধে যেন নতুন জীবন পায় বায়ার্ন। পাশে আলকান্ত্রাকে পেয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন তোলিসো, যিনি টটেনহামের মিডফিল্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খেলতে পারছিলেন না। ফলে বায়ার্নের আক্রমণে আসে ধার। আর সে আগুনে আক্রমণে ছারখার হয়ে যায় টটেনহামের রক্ষণভাগ। আলকান্ত্রার সঙ্গে সার্জ গেন্যাব্রির জাদুতে ৭-২ গোলের বিরাট জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে বায়ার্ন।
কে বলে ভালভার্দে আর কোভাচ দলকে জেতাতে পারেন না!