টেস্ট কতটা ভালোবাসেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা
>বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের নিম্ন মান, দুর্বল পাইপলাইন, খেলোয়াড়দের ফিটনেসে ঘাটতি, টেম্পারামেন্ট–স্কিলে ঘাটতি। আফগানদের কাছে টেস্ট হারের পর কত বিষয় চলে আসছে সামনে। সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নটা হচ্ছে, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা টেস্ট কতটা ভালোবাসেন?
বছর দুয়েক আগে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে ছোট্ট একটা জরিপ চালিয়েছিল প্রথম আলো। নয় তরুণ খেলোয়াড়ের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ক্রিকেটের কোন সংস্করণে তাঁদের বেশি আগ্রহ বা কোন সংস্করণে খেলতে বেশি ভালো লাগে?
টি-টোয়েন্টির কথা না বললেও টেস্টের প্রতিও খুব বেশি খেলোয়াড় আগ্রহ প্রকাশ করেননি। তাঁদের বেশি পছন্দ ৫০ ওভার, অর্থাৎ ওয়ানডে ক্রিকেট। নয় তরুণ খেলোয়াড়ের মাত্র একজন বলেছিলেন টেস্টের প্রতিই তাঁর বেশি আগ্রহ।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্ট হারের পর বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের নিম্ন মান, দুর্বল পাইপলাইন, শর্টকাটে বিসিবির সাফল্য পাওয়ার মানসিকতা, খেলোয়াড়দের ফিটনেসে ঘাটতি, টেম্পারামেন্ট-স্কিলে ঘাটতি। কত বিষয় চলে আসছে সামনে। সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নটা হচ্ছে, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা টেস্ট কতটা ভালোবাসেন? লাল বলের ক্রিকেটের চেয়ে সাদা বলের ক্রিকেটে প্রতিই যদি বেশি আগ্রহ থাকে, ক্রিকেটাররা টেস্টে ধারাবাহিক ভালো করবেন কী করে?
নাম না প্রকাশের শর্তে বিসিবির এক পরিচালক কাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে বেশ ক্ষোভ নিয়েই বলছিলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগ ক্রিকেটার ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মন থেকে যতটা উপভোগ করে, টেস্ট ততটা করে না। হ্যাঁ, কিছু খেলোয়াড় আছে—যেমন: মুশফিক-তামিম—এরা টেস্ট অনেক পছন্দ করে। বাকিরা তেমন করে না। কারণ, তারা জানেই না টেস্ট কীভাবে খেলতে হয়।’
পরশু জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সাকিব আল হাসানকে ঠিক এই প্রশ্নটা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ টেস্ট অধিনায়ক অবশ্য পুরোপুরি একমত হননি, আবার খুব একটা দ্বিমতও পোষণ করেননি, ‘(সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বেশি আগ্রহী) হতে পারে, একেকজন মানুষের ভাবনা তো একেক রকম থাকে। মনমানসিকতাও একেক রকম। কার ক্ষেত্রে বিষয়টি কেমন, আসলে বলা মুশকিল। আলাদা আলাদাভাবে যার যার মতামত সে দিতে পারবে যে কার (টেস্ট) খেলার ইচ্ছা আছে বা কার ইচ্ছা নেই। তবে আমার কাছে মনে হয় না যারা এই দলে আছে, তারা টেস্ট খেলতে চায় না কিংবা খেলার ইচ্ছা নেই তাদের।’
সাকিব যা-ই বলুন, বছর দুয়েক আগে সিডনিতে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) বার্ষিক সভায় নির্জলা এক সত্য তুলে ধরেছিলেন। সেখানে বলেছিলেন, টি-টোয়েন্টি থেকে বেশি আয়ের সুযোগ থাকায় বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ ক্রিকেটার টেস্ট ক্রিকেটকে আর তাঁদের লক্ষ্য হিসেবে দেখেন না। বাঁহাতি অলরাউন্ডারের যুক্তি উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। ঘরোয়া ক্রিকেটে একজন খেলোয়াড় টি-টোয়েন্টি আর ৫০ ওভারের লিগ বা টুর্নামেন্ট খেলে যা আয় করেন, সেটির তিন ভাগের এক ভাগও আয় করা যায় না বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ (বিসিএল) কিংবা জাতীয় লিগ (এনসিএল) খেলে। কদিন আগে একজন তরুণ ক্রিকেটার রসিকতা করেই বলছিলেন, ‘লাল বলে কষ্ট বেশি, উপার্জন কম!’ ক্রিকেটে টেস্টের মর্যাদা কতটা, তিনি জানেন। জানেন, টেস্টে ভালো খেলতে পারলে সব সংস্করণেই ভালো খেলা যায়। এও জানেন, টেস্ট হচ্ছে ‘টোটাল ক্রিকেট’। এটার মধ্যে ক্রিকেটের তিন সংস্করণের স্কিলের পরীক্ষা হয়। তবু টেস্টটা যেন ঠিক উপভোগ করেন না তিনি। আরও একটি বিষয় টেস্ট থেকে দূরে থাকতে তাঁকে উৎসাহিত করে, ‘বছরে আমরা খেলিই গড়ে চার-পাঁচটা টেস্ট। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি বরং বেশি খেলি। যেটা বেশি খেলি, সেটা নিয়ে বেশি ভাবব, সেটাই স্বাভাবিক।’
টেস্টের প্রতি ক্রিকেটারদের আগ্রহী করে তুলতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড চাইলে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার পথে হাঁটতে পারে। ইংল্যান্ডে একটা সময় ছিল শুধু টেস্টে যাঁরা ভালো করবেন, তাঁরাই কেন্দ্রীয় চুক্তিতে থাকতে পারবেন। গত তিন বছরে অবশ্য কেন্দ্রীয় চুক্তির নিয়মে কিছুটা বদল এনেছে তারা। টেস্টের পাশাপাশি সাদা বলের ক্রিকেটারদের আলাদা চুক্তির ব্যবস্থা রেখেছে।
বাংলাদেশে এই পদ্ধতি চালু করা যে সহজ নয়, জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিবির ওই পরিচালক, ‘ভারতে কোহলির চেয়ে কি ধোনির বেতন বেশি? আমাদের এখানে বিপরীত চিত্র। মাশরাফি (বিন মুর্তজা) এক সংস্করণ খেলে সবচেয়ে ওপরের গ্রেডেই থাকছে। বাংলাদেশে চাইলেও অনেক কিছু করা যায় না।’
শুধু টেস্ট ক্রিকেটারদের চুক্তিতে রেখেও কি কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে? যে কাজটা মন থেকে ভালোবাসা যায় না, অনুভব করা যায় না, সেটির অলিগলি অনেকটা অজানা, সেটিতে সাফল্য পাওয়া এতই সহজ?