এক মাসের ব্যবধানে বয়স বেড়ে গেল এক বছর
২০১৯ সালের আগস্ট মাসে রাকিবুল ইসলামের বয়স ছিল ১৫ বছর। তাহলে এ বছরের সেপ্টেম্বরে রাকিবুলের বয়স কত হবে?
বলতেই পারেন, দূর, এটা আবার উত্তর দেওয়ার মতো কোনো প্রশ্ন? কিন্তু গণিতের হিসাবকেই ভুল প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ দলের অধিনায়ক। রাকিবুলের সঙ্গে কিশোর দলের আরও ১০ ফুটবলারের বয়সও ভুল প্রমাণ করেছে গাণিতের যোগ–বিয়োগকে। কারণ, এক মাসের ব্যবধানে তাদের বয়স বেড়েছে এক বছরেরও বেশি!
না, অঙ্কে কোনো ভুল নেই। এই ঘটনায় অভিযোগের তীর গেছে, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) বয়স লুকানোর অভ্যাসের দিকে। গত মাসে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কল্যাণীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ ফুটবল। পাঁচ দলের সাফে তৃতীয় হয়ে টুর্নামেন্ট শেষ করেছে আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। সেই টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার তিন সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশ দল খেলতে যাচ্ছে কাতারে। সেখানে হবে অনূর্ধ্ব-১৬ এএফসি চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্ব। এ বাছাইপর্বের সুবাদেই বিস্ময়কর তথ্যটি জানা গেল। অনূর্ধ্ব-১৫ খেলা অধিকাংশ ফুটবলার যেতে পারছে না অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্বে। কারণ, তাদের বয়স বেশি হয়ে গেছে অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে ১৬ বছর ছাড়িয়ে গেছে।
যে ফুটবলারদের অনায়াসে সাফের অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টে খেলিয়ে এনেছে বাফুফে, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে তারাই এখন এক বছরের বেশি বয়সের এএফসির টুর্নামেন্ট খেলতে পারছে না। বয়স নির্ধারণ পরীক্ষায় (এমআরআই) ধরা পড়েছে তাদের বয়স ১৬ বছর পেরিয়ে গেছে। অর্থাৎ ১৬ বছরেরও বেশি বয়সের ১১ খেলোয়াড় নিয়ে অনূর্ধ্ব-১৫ সাফে খেলতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এই খেলোয়াড়দের নাম—রাকিবুল ইসলাম, মুন্না আহমেদ, শুভ সরকার, সাব্বির গাজি, গোলাম রাব্বি, জয়ন্ত লাল, শাহিন মোল্লা, রাব্বি হোসেন, বাদশা মিয়া, আরিফুর রহমান রাজু ও আল আমিন রহমান।
দল দেশে ফেরার পরই ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের। নতুন করে নেওয়া হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী খেলোয়াড়। বাদ পড়া এক খেলোয়াড়ই স্বীকার করেছে সেটা। জানিয়েছে, ‘আমাদের ১১ জনকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন স্যাররা। বলা হয়েছে, এমআরআই টেস্টে আমাদের বয়স ১৬–এর বেশি এসেছে। তাই আমরা এএফসির টুর্নামেন্ট খেলতে পারব না।’
সাফের টুর্নামেন্টে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বয়স পরীক্ষা না হওয়ার সুযোগটাই নিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এএফসির টুর্নামেন্টে বয়স নিয়ে লুকোচুরি খেলে ধরা পড়লে বড় শাস্তির শঙ্কা থাকায় শুদ্ধ হয়ে কাতারে দল পাঠাতে চায় বাফুফে। সে মিশনে এমআরআই টেস্টে ধরা পড়াদের আগেভাগে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের এক কোচও, ‘দলের ১০-১২ জন খেলোয়াড়ের এমআরআই টেস্টে বয়স বেশি এসেছে। ফলে এএফসির জন্য বাধ্য হয়ে নতুনভাবে দলটা সাজাতে হয়েছে।’
বয়স অনুসন্ধান করতে গিয়ে বের হয়ে এসেছে আরও একটি তথ্য। প্রথমে জানা গিয়েছিল অসুস্থতার কারণে দলের সঙ্গে যেতে পারেননি ব্রিটিশ কোচ রবার্ট। কিন্তু দলসংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, খেলোয়াড়দের বেশি বয়সের কারণেই শেষ মুহূর্তে সফর বাতিল করেছিলেন কোচ। আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে দল নিয়ে কথা বললেও পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার আগেই তাঁর হাতে এসে পৌঁছায় খেলোয়াড়দের এমআরআই রিপোর্ট (এমআরআই করা হয়েছিল ৭ আগস্ট।) এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে দলের সঙ্গে যাননি। বরং এএফসির টুর্নামেন্টের জন্য দল মেরামতের লক্ষ্যে নতুন খেলোয়াড়দের ডেকে ট্রায়ালের ব্যবস্থা করেন এই ব্রিটিশ। আর তাঁর স্থলে প্রধান কোচ হিসেবে পাঠানো হয় মোস্তফা আনোয়ার পারভেজকে।
নতুন একটি দল নিয়ে কাতার ও ইয়েমেনের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে এএফসির বাছাইপর্বে খেলতে হবে বাংলাদেশকে। পূর্ণশক্তির দল ও বয়স্ক খেলোয়াড় নিয়েই নেপাল ও ভারতের বিপক্ষে ৪ গোল হজম করতে হয়েছে। এবার সংস্কার করা দল নিয়ে কাতার ও ইয়েমেনের মতো দলের বিপক্ষে খেললে কী হতে পারে, তা অনুমেয়ই। গ্রুপ ‘ই’–তে বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য দলটি ভুটান।
বয়সভিত্তিক ফুটবলে বাংলাদেশের বয়স চুরির রীতি নতুন নয়। পরিকল্পনাবিহীন ফুটবলে শর্টকাটে সাফল্য লাভের আশায় অনেক আগে থেকেই দীর্ঘমেয়াদি এই ক্ষতির পথে পা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে সাফের কয়েকটি বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনেও অনেকে বেশি বয়সী খেলোয়াড়ের অভিযোগ তোলেন। ২০১৬ সালে সিলেটে অনুষ্ঠিত কিশোর সাফ জিতেছিল বাংলাদেশ। অথচ এক মাসের ব্যবধানেই চ্যাম্পিয়ন দলের গুরুত্বপূর্ণ তিন সদস্য সাদ উদ্দিন, আতিকুর রহমান ও খলিল ভূঁইয়া এএফসির টুর্নামেন্টে খেলতে পারেনি বেশি বয়সের জন্য। আবার সেই দলের পাঁচ ফুটবলারকে পরের বছরে অনূর্ধ্ব-১৪ মক কাপে খেলিয়ে প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। অর্থাৎ ২০১৬ সালে যে খেলোয়াড় অনূর্ধ্ব-১৬ খেলেছে, তাদের দিয়ে এক বছর পরে খেলানো হয়েছে অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবল।
আরও পেছনে ফিরে গেলে ডানা ও গোথিয়া কাপের গল্প তো ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। ১৯৯০ সালে অনূর্ধ্ব-১৪ ডানা কাপ ও গোথিয়া কাপে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্সের মতো দলগুলোকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। দেশের ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন দেখা মানুষগুলো তো বিশ্বকাপে খেলার আশাই করতে শুরু করেছিল। কিন্তু পরে টিভিতে সে খেলা দেখেই ভ্রম ভাঙে দেশের মানুষের, পূর্ণবয়সী ফুটবলারদের নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল ১৪ বছরের কিশোরদের সঙ্গে। এ ছাড়া ১৯৯৯ সালে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ বাছাইপর্বেও বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের বয়স নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রতিপক্ষ কোচেরা। ২০০০ সালে ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত এএফসির অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টে বেশি বয়স নিয়ে খেলার অপরাধে নিষিদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশের তিন ফুটবলার। এদের মধ্যে একজন মাহবুবুল আলম পলো আলোচ্য অনূর্ধ্ব-১৫ দলের সঙ্গেই ছিলেন সহকারী কোচ হিসেবে।
বয়সভিত্তিক পর্যায়ে অধিক বয়সী খেলোয়াড় খেলিয়ে সাময়িক সাফল্য পেলেও ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকি। এ সত্য সাধারণ ফুটবলপ্রেমীরাও জানেন এখন। অথচ এই বয়স লুকানোর ভয়াবহ রীতি থেকে বেরিয়ে আসার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। নগদ সাফল্যের আশায় বেশি বয়সী খেলোয়াড়দের জায়গা দিয়ে এই ফুটবলারদের ক্যারিয়ারও হুমকিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আর বয়সসীমায় থাকা যোগ্য ফুটবলারদেরও নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে ভবিষ্যৎ নিয়ে। বাংলাদেশের ফুটবলের লাইফ লাইন হতে পারত যুব ফুটবল, কিন্তু সেটাও আবার হাসি–তামাশায় রূপ নিচ্ছে ধীরে ধীরে।