হ্যাজার্ডকে যেভাবে দেখা যেতে পারে রিয়ালে
রিয়াল মাদ্রিদ তাহলে শেষ পর্যন্ত এডেন হ্যাজার্ডকে কিনল!
বিস্ময়সূচক চিহ্নটা রাখতেই হচ্ছে। এ চুক্তি সইয়ের চেষ্টাচরিত্র চলছিল তো দু-এক বছর ধরে নয়। হ্যাজার্ড-রিয়াল মাদ্রিদ সংযোগের বয়স পাক্কা এক দশক ধরে। ২০০৯ সালের মে মাসে জিনেদিন জিদানই বলেছিলেন রিয়ালকে, ১৮ বছর বয়সী ছেলেটাকে নিয়েও নাও। হ্যাজার্ড সেই মৌসুমে লিঁলের হয়ে ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ানের সেরা তরুণ ফুটবলার। রিয়ালের উদ্দেশে জিদান সোজাসাপ্টাই বলেছিলেন, ‘আমি হলে চোখ বুঁজে হ্যাজার্ডকে নিয়ে নিতাম।’
সেই মন্তব্যের বছরখানেক সময় না পেরোতেই জিদান আরও একবার কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন রিয়ালকে, ছেলেটাকে নিয়ে নাও—বেলজিয়ান উইঙ্গার সেই মৌসুমেও লিগ ওয়ানের সেরা তরুণ খেলোয়াড়। আর জিদান ছিলেন রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের অনানুষ্ঠানিক উপদেষ্টা। বোঝাই যাচ্ছিল, হ্যাজার্ডকে তখন থেকেই ভালোই মনে ধরেছে জিদানের। ‘সে ভবিষ্যৎ তারকা। গতি আর ব্যক্তিগত দক্ষতা আছে। জানি সে একদিন অসাধারণ খেলোয়াড় হয়ে উঠবে।’
জিদান ভুল বলেননি আর পেরেজেরও হ্যাজার্ডকে না কেনার যৌক্তিক কারণ ছিল। রিয়াল সভাপতি তখন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো-কাকাদের নিয়ে আরেকটি ‘নক্ষত্রপুঞ্জ’ গড়তে ব্যস্ত। এরপর জল গড়িয়েছে অনেক। লিঁলের হ্যাজার্ড চেলসির হয়েছেন। চেলসি হ্যাজার্ডকে যেমন ছাড়েনি তেমনি রোনালদোও রিয়ালের বাঁ প্রান্তের উইংয়ের জায়গা ছাড়েননি—যে জায়গাটায় হ্যাজার্ড খেলতে অভ্যস্ত। এত দিন পর বেলজিয়ান তারকাকে রিয়াল কেন কিনল সেই যুক্তিটাও পরিষ্কার—জিদান দলটির কোচ ও লেফট উইংয়ে রোনালদোর শূন্যতা পূরণে যোগ্য কাউকে দরকার ছিল। এমন কেউ, যিনি প্রায় একাই বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লিগ জেতাতে ‘নিউক্লিয়াস’ হতে পারেন চেলসির মতো ক্লাবে। এখন প্রশ্ন হলো, পরিণত হ্যাজার্ডকে কীভাবে, কোথায় ব্যবহার করবেন জিদান?
একটি বিষয় পরিষ্কার—জিদান আক্রমণাত্মক ও গতিময় ফুটবল পছন্দ করেন। ফরাসি কিংবদন্তির অধীনে রিয়ালের টানা তিন চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের মৌসুম স্মরণ করলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। মাঠের দুই প্রান্তের স্বচ্ছন্দ ব্যবহারের সঙ্গে মাঝমাঠ দিয়েও ‘ফ্লুইড’ ফুটবল খেলিয়েছেন জিদান। রোনালদোর প্রস্থানের পর তৈরি হওয়া শূন্যতায় গত মৌসুমে ভরাডুবির পর রিয়াল আবারও জিদানকে কোচ পদে ফেরানোয় রিয়ালের খেলার সেই ধাঁচটা ফিরে আসার সম্ভাবনাই বেশি। আর তাতে হ্যাজার্ড হতে পারেন সেরা সংযোজন, পূরণ করতে পারেন রোনালদোর শূন্যতাও—আর সেটি অবশ্যই বাঁ প্রান্তে।
বিপত্তিটা হলো ভিনিসিয়ুস জুনিয়র ওই একই পজিশনে (লেফট উইঙ্গার) রিয়ালে অভিষেক মৌসুমেই আলো ছড়িয়েছেন। গতি আর দুর্দান্ত ড্রিবলিংয়ে রিয়ালে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়েছেন এই ব্রাজিলিয়ান। বাধা বলতে শুধু ইনজুরিপ্রবণতা। আর জিদান যেহেতু রিয়ালকে ঢেলে সাজাচ্ছেন, তাই বাঁ প্রান্তে পরীক্ষিত খেলোয়াড়ের ওপরই আস্থা রাখবেন—যে খেলোয়াড় সেখান থেকে ড্রিবলিং কিংবা গতিতে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দিয়ে বক্সে ঢুকে ডান পায়ে পোস্ট বরাবর বাঁকানো শট নিতে পারবেন। বার্সেলোনায় লিওনেল মেসি কিংবা বায়ার্ন মিউনিখে আরিয়েন রোবেনের স্বভাবজাত খেলা যেমন ঠিক, তার উল্টো পজিশন থেকে হ্যাজার্ড ঠিক একই কাজ করবেন রিয়ালে। আর কে না জানে, ডান পায়ের হ্যাজার্ড কতটা ভয়ংকর!
হ্যাজার্ডকে বাঁ প্রান্তের উইংয়ে জায়গা দিতে ভিনিসিয়ুসকে সম্ভবত ডান প্রান্তের উইংয়ে খেলাবেন জিদান। আর করিম বেনজেমা সামনে থেকে একই ভূমিকা পালন করবেন, যা রোনালদো থাকতে করতেন। প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের ব্যতিব্যস্ত রেখে হ্যাজার্ডকে খেলার জায়গা করে দেওয়া। ‘ফলস নাইন’ হিসেবে খেলার অভিজ্ঞতাও আছে হ্যাজার্ডের। চেলসিতে এ মৌসুমের শুরুতে এ ভূমিকা পালন করেছেন বেশ দায়িত্বের সঙ্গেই। মার্কো অ্যাসেনসিওকে ভুলে গেলে চলবে না। বাঁ পায়ের এই উইঙ্গার/অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারকে নিয়ে রিয়াল আক্রমণভাগের ছবিটা পরিষ্কার করেছেন জিদান—যা ‘বিবিসি’র মতোই ‘ত্রিফলা’। হ্যাজার্ড, অ্যাসেনসিও ও ভিনিসিয়ুসকে নিয়ে গড়া এই ত্রিফলা আক্রমণভাগের সামনে অতিরিক্ত ফলা হিসেবে থাকবেন বেনজেমা। আসলে বেনজেমার ভূমিকাটা হবে সব মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার। এই সু্যোগে কাজ যা করার করবেন ত্রয়ী জুটি।
গ্যারেথ বেলের চোটপ্রবণতায় জন্য তাঁকে ডান প্রান্তে রেখে পছন্দের ৪-৩-৩ ফরমেশনে জিদান তাঁর শিষ্যদের হয়তো খুব কমই খেলাতে পেরেছেন। বিকল্প হিসেবে ৪-৩-১-২ ফরমেশনে আরও স্বচ্ছন্দ ফুটবল খেলিয়েছেন জিদান। যেখানে রোনালদো-বেনজেমার পেছনে ইসকো ছিলেন ‘নম্বর টেন’-এর ভূমিকায়। জিদানের নতুন রিয়ালে মাঝেমধ্যে হ্যাজার্ডকে ইসকোর ভূমিকায় দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ভিনিসিয়ুস ও বেনজেমাকে সামনে রেখে পেছনে থাকবেন হ্যাজার্ড—‘ট্রেকুয়ার্তিস্তা’—নিখাদ অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার আরকি। তবে সার্বিয়ান স্ট্রাইকার লুকাস ইয়োভিচ আসায় বেনজেমার সঙ্গে তাঁকেও সামনে খেলাতে পারেন জিদান। আর যদি ম্যাচের মধ্যে গোলের প্রয়োজন হয় তাহলে?
৪-২-৪ ফরমেশনই সমাধান। যেখানে ইয়োভিচ, হ্যাজার্ড, ভিনিসিয়ুস আর বেনজেমাকে খেলতে দেখা যাবে সামনে। সত্যি বলতে, আক্রমণভাগে হ্যাজার্ডকে ইচ্ছেমতোই ব্যবহারের সুযোগ পাবেন জিদান। ‘ভার্সেটাইল’ হওয়াতেই সম্ভবত হ্যাজার্ডকে নিয়ে জিদান একবার বলেছিলেন, ‘মেসি-রোনালদো অসাধারণ তবে আমি হ্যাজার্ডকে বেশি পছন্দ করি।’ এই পছন্দের কারণটা নিশ্চয়ই টের পাওয়া যাবে আগামী মৌসুমে।
জিদান বিশ্বাস করেন, হ্যাজার্ডের মধ্যে রোনালদোর বিকল্প মিলেছে। আর মিলেছে লা লিগায় লিওনেল মেসির নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীও। কোচের এ বিশ্বাসের চাপটা হ্যাজার্ড নিশ্চয়ই টের পাচ্ছেন? পরীক্ষিত যোদ্ধা বলেই এই চাপ তাঁর কাছে প্রেরণা হওয়ার কথা।