বিদায় 'ফ্লাইং ডাচম্যান'!
>ডেলে ব্লিন্ডের কাছে থেকে এত বড় ক্রস আশা করেননি রবিন ফন পার্সি। বয়সটা ৩০ পেরিয়েছে, দৌড়ে ধরা খুব একটা কঠিন হবে না... যা আছে কপালে! অনেকটা এমন ভেবেই সার্জিও রামোসকে ডজ দিয়ে বক্সের ভেতরে ঢুকে দিলেন এক লাফ, দেখা যাক কী হয়!
৬ আগস্ট, ১৯৮৪; পার্সি দম্পতি বসবাস শুরু করেন শহর ছেড়ে দূরে, রটারডামে। বব আর হোসের সংসারের তৃতীয় সন্তান রবিনের জন্ম এই নির্মল রটারডামে। মা হোস র্যাস ছিলেন চিত্রশিল্পী, বাবা ছিলেন ভাস্কর। জিনগতভাবেই শিল্প তাঁর রক্তে। শুধু উঁকি দেওয়ার অপেক্ষা। পরিবারের সঙ্গে থাকলে হয়তো শিল্পীমন খুঁজে নিত মাটির কারুকাজ কিংবা ছবির খাতা। কিন্তু পরিবার টিকলে তো? পার্সির সামনেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল বাবা-মায়ের। অদ্ভুত সমাজ থেকে পার্সি যেন দৌড়ে পালাতে চাইল। কিন্তু পালানো কী এত সহজ?
স্কুল কখনোই পার্সির জন্য ছিল না। শিক্ষকদের অতিষ্ঠ করায় জায়গা হতো মাঠের মাঝখানে। না খেলার জন্য নয়, শাস্তি হিসেবে। বাবা অবশ্য তাঁকে নিয়ে চিন্তা করার ধারেকাছেও যাননি। বব ফন পার্সির বিশ্বাস ছিল, ছেলের মাথার ভেতর যে কণ্ঠ সারা দিন ক্রুইফ হওয়ার কথা তুলছে, সে কণ্ঠ আর যা–ই হোক ভুল করবে না। পাঁচ বছর বয়সে তাঁকে দলে ভিড়িয়েছিল এক্সেলসিয়র।
নেদারল্যান্ডসের প্রতিটি দলেরই খেলার নিজস্ব কিছু ধরন থাকে। এক্সেলসিয়রের বৈশিস্ট্য ছিল ‘স্ট্রিট ফুটবল’। সহজাত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে যেখানে পার্সি হয়ে উঠেছিলেন সেরা। তাঁকে গড়ে তোলার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল এক্সেলসিয়র। সেখানে ১১ বছর শেষে যখন এক্সেলসিয়র থেকে ফেইনুর্দে দলবদল করলেন পার্সি, তত দিনে তিনি ক্লাবের সেরা তরুণ। চুলের ছাঁটে ফুটবল, বাবার পছন্দের দল আর্সেনালকে মনে গেঁথে ফেলা, ইয়োহান ক্রুইফের কাছ থেকে সরাসরি আশীর্বাদ পাওয়া; এই সবকিছুই ১৩ বছর বয়সের আগেই পেয়ে গিয়েছিলেন পার্সি। ভয় ছিল, সব পেয়ে না আবার বখে যান! কিন্তু রবিন ফন পার্সির উত্থান তো বখে যাওয়ার জন্য হয়নি।
এক্সেলসিয়র ক্যারিয়ার শেষে পার্সি পাড়ি জমান ফেইনুর্দে। স্বপ্ন ছিল এক্সেলসিয়রে মেলা পাখা আরও বড় করবেন। কিন্তু কিসের কী? মুক্ত পাখি হতে চাওয়ার আশায় উল্টো খাঁচাতেই বন্দী হয়ে পড়লেন রবিন। কোচ বার্ট ফন মারউইকের সঙ্গে খেলার ধরন নিয়ে ঝামেলায় বেশির ভাগ সময়েই রিজার্ভ বেঞ্চে বসে থাকতে হতো তাঁকে। আগেই বলা হয়েছে, নেদারল্যান্ডসের প্রতিটি দল থেকে প্রতিটি দল ভিন্ন, খেলার ধরন, খেলার চাপ সবকিছুই। এক্সেলসিয়রের ‘স্ট্রিট ফুটবল’ থেকে ফেইনুর্দের ‘পজেশনাল ফুটবল’–এ এসে পার্সি যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেললেন।
অথচ পার্সি পালাতে চাইলেও কখনো হারিয়ে যেতে চাননি, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর যখন হারানোই ছিল তাঁর ভবিষ্যৎ, তখন হারাননি। বারবার স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার পরও টিকে ছিলেন। ফেইনুর্দে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা, ঘুরে দাঁড়ালেন তখনই। ফন মারউইক যতটুকু সুযোগ দিলেন ততটুকুই কাজে লাগালেন। সেটুকু যথেষ্ট ছিল আর্সেনাল কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের জন্য। ফন পার্সির মধ্যেই নিজের ভবিষ্যৎ বার্গক্যাম্পকে দেখে ফেললেন ওয়েঙ্গার।
লাল-সাদা জার্সিটা প্রথম দেখেছিলেন বাবার গায়ে। রেডিওতে মাঝেমধ্যেই গোলের চিৎকার শুনে লাফিয়ে উঠতেন বব। সেই থেকে সম্পর্ক এই লাল-সাদা জার্সির সঙ্গে। রটারডাম থেকে লন্ডন—৪৭৬ কিলোমিটার দূরে ক্লাবটির সমর্থনে বাবা-ছেলে জুটির কথা হয়তো আর্সেন জানতেন না। কিন্তু রবিনকে চিনতেন। মাত্র আড়াই মিলিয়ন দিয়ে ফেইনুর্দ থেকে কিনে এনেছিলেন পার্সিকে। একরকম ‘বন্দিদশা’ থেকে মুক্ত হওয়ার আশায় ছিলেন পার্সিও।
শুরু হলো ডাচ তরুণের ইংলিশ ভ্রমণ। খেলার ধরন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন বটে, তবে বেঞ্চে বসে থাকার অসহ্য যন্ত্রণা থেকে নয়। আর্সেনও বুঝলেন, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ভরসা রাখলেন পার্সিতেই। প্রতিদান পেলেন হাতেনাতে। কিন্তু বেরসিক চোট আঘাত হানল বারবার। দেয়ালে পিঠ ঠেকলে কী করতে হয়, তা জানা ছিল পার্সির। হয় সামনে এগোতে হয়, নইলে ভেঙে ফেলতে হয় দেয়াল।
এমিরেটস গড়লেন আর্সেন, নিজের পকেটের টাকা খরচ করতে গিয়ে একে একে হারালেন শিষ্যদের। লেফট উইঙ্গার থেকে স্ট্রাইকার হয়ে উঠলেন ফন পার্সি হয়ে উঠলেন ডাচ দলের মাথা। গায়ে চড়ালেন কমলা জার্সি, খেললেন বিশ্বকাপ ফাইনাল। কিন্তু দেয়ালে পিঠটা ঠেকেই থাকল; কেন জানি সব পাওয়া হচ্ছে, শুধু শিরোপা ছুঁয়ে দেখা হচ্ছে না। গোল্ডেন বুট, সেরা খেলোয়াড় সবই ছোঁয়া হলো, শুধু শিরোপাটা ছোঁয়া হলো না!
পার্সির শিরোপা ছোঁয়ার ইচ্ছেটা বড্ড বেশি। আর্সেনালে ভালোবাসা পেয়েছেন, নিজে হয়েছেন স্ট্রাইক ফোর্স, গানার্সদের কাছে হয়েছেন দেবতুল্য। কিন্তু শিরোপার নেশা বড্ড বড় নেশা। তার ছোঁয়া পেতেই আর্সেনকে ওয়েঙ্গারকে পার্সি বলে বসলেন, এবার আমায় যেতে যাও। পার্সি পাড়ি জমালেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে।
স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ফন পার্সিকে কিনেছিলেন দুটি কারণে, নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার সিটির কাছ থেকে হারানো লিগ পুনরুদ্ধার আর বিদায়ের আগে আরেকটি লিগ নিজের নামের পাশে যোগ করা। পার্সিও সে ইচ্ছে পূরণ করতেই যোগ দিয়েছিলেন ম্যানচেস্টারে। গিয়েই গায়ে জড়িয়েছিলেন ‘২০’ নম্বর জার্সি। ‘রেড ডেভিল’দের ২০ নম্বর প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা এনে দেবেন বলেই এই নম্বর নেওয়া। পার্সি কথা রেখেছিলেন। ২০তম ইংলিশ লিগ শিরোপা বুঝিয়ে দিলেন ‘রেড ডেভিল’ সমর্থকদের।
সেই বিশ্বকাপ ফাইনালের পর চার বছর ধরে প্রতিটি দিন পুড়িয়েছে ফন পার্সিকে। ১২০ মিনিট সবটা দিয়েই খেলেছেন পার্সি, কিন্তু পারেননি। ক্রুইফের কাছে যে কথা দিয়েছিলেন মাত্র ১১ বছর বয়সে, তা রাখতে পারেননি পার্সি। প্রতিশোধের আগুন প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে ছিল। প্রতিশোধ সেই ম্যাজিশিয়ানের বিপক্ষে যে চোখের সামনে কেড়ে নিয়েছিল বিশ্বকাপ। সেই ক্যাসিয়াসের বিপক্ষে, যে ‘সন্তু’ একাই থামিয়ে দিয়েছিল ডাচদের জয়রথ। আর তাই সেদিন ব্লিন্ডের ক্রস দেখেই বুঝে নিলেন কী করতে হবে। নিজেদের প্রচলিত রূপকথা হতে হবে তাঁকে। হতে হবে ‘ফ্লাইং ডাচম্যান’। মধ্যসাগরের সেই ভুতুড়ে এক জাহাজ, যা তাড়া করে বেড়ায় মধ্যসাগরের সব নাবিকদের।
ডি বক্সের ভেতরেই লাফিয়ে উঠলেন ফন পার্সি। ইকার ক্যাসিয়াসের হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। যেন মাঝ সমুদ্রে কূল হারানো দুই মাঝি রামোস আর ক্যাসিয়াস, তাঁদের সামনে হঠাৎ করেই উঁকি দিল সেই ভুতুড়ে জাহাজ। স্পেনের ৫-১ গোলের সেই হার, এক অর্থে কালিমাই। আর সেই কালিমা লেপে দিয়ে গেলেন রবিন ফন পার্সি ওরফে ‘ফ্লাইং ডাচম্যান’!
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে খেলেছিলেন মাত্র তিন বছর। তারপর দুই বছর ছিলেন তুরস্কে। তুরস্ক ঘুরে আবারও ফিরলেন ঘরে। ঘর মানে সেই ফেইনুর্দ—যেখানে পার্সির স্বপ্ন বোনার শুরু। বুনতে বুনতে তা হয়ে উঠল বিশাল কাব্যগাথা। ১২ বছরের ক্যারিয়ারে ডাচদের হয়ে সর্বোচ্চ গোল, তিনটি বিশ্বকাপ খেলা কিংবা অধিনায়ক হওয়া—রবিন ফন পার্সিকে তাঁর ক্যারিয়ারের এতশত হিরণ্ময় মুহূর্ত থেকে একটা মুহূর্ত বের করতে বললে থমকে যাবেন নিশ্চয়ই? তাঁর সেরা স্মৃতি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে নেদারল্যান্ডস আর ইংল্যান্ডের অনেকটাজুড়ে।
সব স্মৃতিকে একসঙ্গে জুড়ে দেওয়ার ব্যবস্থাই করেছিল ফেইনুর্দ। ২০ বছরের ক্যারিয়ারে ঘুরেছেন নেদারল্যান্ডস থেকে তুরস্ক। এক্সেলসিয়র থেকে ফেইনুর্দ, এরপর আর্সেনাল-ইউনাইটেড-ফেনারবাখ ঘুরে আবারও ফেইনুর্দে। ক্লাবটি তাঁর পাঁচ ক্লাবের জার্সি এক করে অসাধারণ ‘ম্যাশ-আপ’ জার্সি তৈরি করে পার্সির জন্য। কিংবদন্তির বিদায় বুঝি এমনই হয়! শেষ ম্যাচের পুরো ৯০ মিনিট খেলেছেন ফন পার্সি, তার শেষ ম্যাচে জয় পায়নি ফেইনুর্দ। বিদায়ে তাই বিষাদের রং ছিল। কিন্তু কিংবদন্তির বিদায় থেকে বেশি বিষাদ আর কিসে হতে পারে?
নিজের প্রিয় ক্লাব আর্সেনালের চোখের মণি হয়ে থাকতে পারেননি পার্সি। শিরোপা জয়ের নেশায় ক্লাব ছাড়ায় মুহূর্তেই ‘চোখের মণি’ থেকে হয়েছেন ‘চোখের বালি’। প্রথমবার ফেইনুর্দ ছেড়েছিলেন কোচের সঙ্গে সমস্যায়। দৌড়ে বেড়িয়েছেন ইংল্যান্ড, শিরোপা জয়ের নেশায়। শেষমেশ তুরস্ক ঘুরে আবারও ফিরে এসেছেন সেই ফেইনুর্দেই। এ যেন স্পিলবার্গের ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ সিনেমার গল্প। ইচ্ছেমতো ছুটে বেড়ানোর পর থামলেন জন্ম স্থানে ফিরে।
বিদায় ‘ফ্লাইং ডাচম্যান’।