গত কয়েক বছর ফুটবলপ্রেমীদের মুগ্ধ করার মতো খেলা উপহার দিলেও ট্রফি কেসে দেখানোর মতো কোনো শিরোপা নেই টটেনহাম হটস্পারের। এবার চ্যাম্পিয়নস লিগে শিরোপাহীনতার গেরো কি কাটবে? চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে ওঠা চার দলকে নিয়ে বিশ্লেষণের দ্বিতীয় পর্বে আজকের দল টটেনহাম
চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিতে ওঠা চার দলের মধ্যে খেলোয়াড়দের ফর্ম ও ফিটনেসের দিক দিয়ে টটেনহামকেই সবচেয়ে দুর্বল বলা চলে। তাই বলে চ্যাম্পিয়নস লিগের সম্ভাব্য শিরোপাজয়ীর তালিকা থেকে এখনই যদি টটেনহামকে বাদ দিয়ে দেন, তাহলে ভুল করবেন। আর এর পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করছে দলটার ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ বা অনিশ্চিত ফুটবল খেলার ক্ষমতা।
কীভাবে অনিশ্চিত? দেখে নেওয়া যাক।
এবারে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিতে ওঠা দলগুলোর মধ্যে টটেনহামই একমাত্র দল, যারা মোটামুটি এক বছর ধরে কোনো নির্দিষ্ট ছকে খেলছে না। সেমিতে ওঠা বাকি তিন দলের প্রতিটিই মোটামুটি ৪-৩-৩ ছকে খেলার চেষ্টা করে। ৪-৩-৩ ছকটাকে মূল ভিত্তি হিসেবে ধরে নিয়ে তারপর প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা বিবেচনা করে পরিকল্পনার একটু এদিক-সেদিক করে তারা। গত পর্বে আয়াক্স সম্পর্কে আলোচনা করার সময়ই বলা হয়েছে, তাদের মূল ছক ৪-৩-৩, কিন্তু সময়-সময়ে সেটা ৪-২-৩-১ এ পরিবর্তিত হয়ে যায়। ওদিকে ম্যাচের পর ম্যাচে দলকে ৪-৩-৩ ছকে খেলাচ্ছেন লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। বার্সেলোনাও মোটামুটি তাই। পূর্ণ শক্তির দল নিয়ে মাঠে নামলে তারা অবশ্যই ৪-৩-৩ ছকে খেলে।
আর এখানেই উজ্জ্বল ব্যতিক্রম টটেনহাম। এক বছর ধরে তাদের ম্যাচগুলোর ছক অবিশ্বাস্য। কোচ মরিসিও পচেত্তিনো টানা দুই ম্যাচ দলকে একই ছকে খেলিয়েছেন, এটা মনে হয় না বলা যাবে। ৩-৪-১-২, ৩-৪-৩, ৩-৫-২, ৪-২-৩-১, ৪-৩-৩, ৪-২-২-২, ৪-৪-২, ৪-৫-১ ; এ বছর প্রতিটি ছকে টটেনহামকে খেলিয়েছেন/খেলাচ্ছেন পচেত্তিনো। এর পেছনে মূল কারণ দুটি।
প্রথম কারণ, এ মৌসুমে দুই দলবদলের বাজারে কোনো নতুন খেলোয়াড় কেনেনি টটেনহাম। ক্লাবের সভাপতি ড্যানিয়েল লেভি ঐতিহ্যগতভাবে বেশ একগুঁয়ে মানুষ। অতিরিক্ত দাম না পেলে নিজের কোনো খেলোয়াড়কে বেচতে চান না। নিজের ক্লাবের জন্য টাকা খরচ করে নতুন খেলোয়াড় কিনতেও তাঁর বেশ অনীহা। খেলোয়াড়দের বাড়তি বেতন দিতে চান না। ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের মতো বিশ্বমানের একজন আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার এখনো প্রতি সপ্তাহে ৭৫ হাজার পাউন্ড আয় করেন টটেনহামে। যেখানে তাঁর মানের বা তাঁর থেকে নিম্নমানের মিডফিল্ডারদের অন্য ক্লাবগুলো লক্ষাধিক পাউন্ড সাপ্তাহিক বেতনের চুক্তি দেয়!
খেলোয়াড়েরা যাতে ক্লাবকে অকূলপাথারে ফেলে ক্লাব ছেড়ে চলে যেতে না পারেন, এ জন্য তাঁদের দলে আনার সময়েই চুক্তিপত্রে হাজারো শর্ত জুড়ে দেন লেভি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কিংবদন্তি ম্যানেজার স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘লিডিং’–এ ড্যানিয়েল লেভি সম্পর্কে চমকপ্রদ কিছু তথ্য দিয়েছিলেন। টটেনহাম থেকে ইংলিশ মিডফিল্ডার মাইকেল ক্যারিক আর বুলগেরিয়ার স্ট্রাইকার দিমিতার বারবাতভকে কিনেছিলেন ফার্গুসন। কিন্তু লেভি তাঁকে যে পরিমাণ যন্ত্রণা দিয়েছিলেন, তার কোনো তুলনা চলে না। বারবাতভকে কেনার সময়টা নিয়ে বলেছিলেন ফার্গুসন, ‘আমার কোমরের অস্ত্রোপচার করাতেও এত কষ্ট হয়নি, যতটা না লেভির সঙ্গে আলোচনা করার সময় হয়েছিল!’
এই লেভির সঙ্গেই এখন সকাল-বিকেল তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে পচেত্তিনোকে। মৌসুমের শুরুতে ক্রিস্টাল প্যালেসের উইলফ্রিয়েড জাহা, আয়াক্সের ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, পিএসজির আদ্রিয়েন রাবিওত, অ্যাস্টন ভিলার জ্যাক গ্রিলিশ, ফুলহামের রায়ান সেসেইয়নসহ বেশ কিছু তরুণ প্রতিভাদের দলে আনতে চেয়েছিলেন পচেত্তিনো। কিন্তু নিজেদের মাঠ হোয়াইট হার্ট লেনকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়েছেন লেভি। যে কারণে এক বিলিয়ন পাউন্ডের বেশি খরচ হয়েছে। ফলে খেলোয়াড় কেনার জন্য অতিরিক্ত খরচ করতে চাননি, পরপর দুই দলবদলের বাজার পেরিয়ে গেলেও কাউকে দলে আনতে পারেননি পচেত্তিনো। প্রবাদে আছে, ‘চাহিদাই উদ্ভাবনের জনক।’ নতুন কোনো খেলোয়াড় দলে না এলেও দলের মান যাতে কমে না যায়, এ জন্য নিজের প্রজ্ঞার ওপর ভরসা রেখেছিলেন পচেত্তিনো। ফলে এক বছর ধরে টটেনহামকে কোনো নির্দিষ্ট ছকে খেলাননি।
দ্বিতীয় কারণ হলো খেলোয়াড়দের চোটপ্রবণতা। বেশ কিছু খেলোয়াড়কে চোটের কারণে সেমিতে পাবে না স্পার্স। যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন দলের সবচেয়ে বড় তারকা ও অধিনায়ক ইংলিশ স্ট্রাইকার হ্যারি কেইন। সেই সঙ্গে ফরাসি মিডফিল্ডার মুসা সিসোকো, আর্জেন্টিনার উইঙ্গার এরিক লামেলা, ইংলিশ মিডফিল্ডার এরিক ডায়ার ও হ্যারি উইংকস, আইভরিয়ান রাইটব্যাক সার্জ অরিয়েররা তো আছেনই। আগেও চোটের কারণে বেশ কিছু খেলোয়াড়কে এই মৌসুমের বিভিন্ন সময়ে পাননি পচেত্তিনো। কেনিয়ার মিডফিল্ডার ভিক্টর ওয়ানিয়ামা মাত্র হাঁটুর চোট সারিয়ে ফিরেছেন। মৌসুমের শুরুর দিকে ম্যাচ ফিটনেস না থাকার কারণে বেশ কিছু ম্যাচ খেলেননি কিয়েরান ট্রিপিয়ের, ইয়ান ভার্তোনে, হ্যারি কেইন, ডেলে আলীরা।
এই দুই কারণই পচেত্তিনোকে বাধ্য করেছে ভিন্ন ভিন্ন ছকে টটেনহামকে খেলানোর জন্য। প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তার ওপর নির্ভর করে ছক কাটেন আর্জেন্টিনার এই ম্যানেজার। যার সুফলও পাচ্ছে টটেনহাম। চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিতে ওঠাই যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
সেমিতে নেদারল্যান্ডসের উদ্যমী ক্লাব আয়াক্সের মুখোমুখি হবে টটেনহাম। একবিংশ শতাব্দীতে নিজেদের উত্থানের পেছনে নেদারল্যান্ডস বা আয়াক্স—কারওর ভূমিকাই খাটো করে দেখে না টটেনহাম। আজ টটেনহাম ইংলিশ লিগের অন্যতম সমীহজাগানিয়া ক্লাব হয়েছে তো ডাচ ইয়লের কল্যাণেই।
ইয়ল আসার আগে ফরাসি কোচ জ্যাক সান্তিনির অধীনে টটেনহাম দম বন্ধ করা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলত। ইয়ল এসে টটেনহামের খেলোয়াড়দের আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেন। দলে নিয়ে আসেন বেশ কিছু খেলোয়াড়, যাঁরা পরবর্তী সময়ে স্পার্সের সাফল্যের অন্যতম কারিগর হিসেবে প্রমাণ করেন নিজেদের। যেমন মাইকেল ডসন, টম হাডলস্টোন, অ্যারন লেনন, জার্মেইন জেনাস, দিমিতার বারবাতভ, গ্যারেথ বেল। এখন টটেনহামের মূল লেফটব্যাক হিসেবে খেলা ড্যানি রোজকেও নিয়ে এসেছিলেন ইয়ল।
ওদিকে টটেনহামের মূল দলের বেশ কিছু খেলোয়াড়ও এসেছেন আয়াক্স থেকে। ডেনমার্কের মিডফিল্ডার ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন, তিন সেন্টারব্যাক টোবি অল্ডারভেইরেল্ড, ইয়ান ভার্তোনে ও ডেভিনসন সানচেজ। ইয়ল যখন আয়াক্সের ম্যানেজার ছিলেন, তখন অল্ডারভেইরেল্ড সাধারণ মানের একজন রাইটব্যাক ছিলেন, ভার্তোনে ছিলেন উঠতি লেফটব্যাক। তরুণ লেফটব্যাক ভার্তোনেকে পাওয়ার জন্য বেশ চেষ্টা করেছিল বার্সেলোনা। পরে তাঁকে না নিয়ে ভ্যালেন্সিয়ার স্প্যানিশ লেফটব্যাক জর্ডি আলবাকে দলে আনে বার্সা। ভার্তোনে আর অল্ডারভেইরেল্ড—দুজনকেই সেন্টারব্যাকে পরিণত করেন ইয়ল। পরিবর্তিত এই দুই সেন্টারব্যাককে দলে আনে স্পার্স। সে থেকে স্পার্সের সেন্ট্রাল ডিফেন্সের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই দুজন। শুধু তা–ই নয়, ইয়ল যখন ফুলহামের ম্যানেজার ছিলেন, বেলজিয়ান মুসা দেম্বেলে সেখানে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতেন। বল পায়ে দেম্বেলের ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেখে তাঁকে মাঝমাঠের খেলোয়াড়ে পরিণত করেন ইয়ল। সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে এই দেম্বেলে পরে টটেনহামে এসে পচেত্তিনোর অন্যতম সৈনিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ইয়লের দেখানো পথ ধরে, আর আয়াক্সের সাবেক কিছু খেলোয়াড়কে নিয়ে এখন স্পার্সকে নতুন উচ্চতায় ওঠাচ্ছেন পচেত্তিনো।
খেলোয়াড়ি জীবনে সেন্টারব্যাক ছিলেন পচেত্তিনো। বাতিস্তুতাদের সতীর্থ হয়ে ১৯৯৮ বিশ্বকাপ খেলেছেন। তাঁর অধীনে ভার্তোনে, অল্ডারভেইরেল্ড, সানচেজ, ফয়থের মতো রক্ষণভাগের খেলোয়াড়েরা নিজেদের সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে দিতে পারছেন স্পার্সের হয়ে। আয়াক্সের বিপক্ষেও এই রক্ষণভাগই টটেনহামের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা। বর্তমানে স্কোয়াডে পাঁচজন ফিট ও কার্যকরী সেন্টারব্যাক থাকার কারণে ও অন্যান্য জায়গায় তেমন ফিট খেলোয়াড় না থাকার কারণে তিন থেকে শুরু করে পাঁচ ডিফেন্ডার বিশিষ্ট যেকোনো ছকে মাঠে নামতে পারে টটেনহাম।
টটেনহামকে আনপ্রেডিক্টেবল বলার আরেকটা কারণ, দলের প্রায় প্রত্যেক খেলোয়াড়ই একাধিক অবস্থানে খেলতে সক্ষম। হিউং মিন সনের কথা ধরুন। দক্ষিণ কোরিয়ার এই তারকা স্পার্সে উইঙ্গার হিসেবে এলেও এখন পচেত্তিনোর অধীনে উইঙ্গার, আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার, সহকারী স্ট্রাইকার, মূল স্ট্রাইকার—যেকোনো ভূমিকাতেই খেলতে পারেন। একই কথা প্রযোজ্য ডেলে আলীর ক্ষেত্রেও। সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা এই তারকা পচেত্তিনোর অধীনেই দেখিয়েছেন, আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে কত অসাধারণ খেলতে পারেন। ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার থেকে শুরু করে উইঙ্গার, এমনকি সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবেও খেলতে পারেন। সেন্টারব্যাক ত্রয়ী ভার্তোনে-অল্ডারভেইরেল্ড-ফয়থ খেলতে পারেন উইংব্যাক হিসেবেও।
ফলে সেমিতে আয়াক্সের বিপক্ষে টটেনহামকে কোন ছকে খেলাবেন পচেত্তিনো, কাকে কোথায় খেলাবেন, কেউই জানে না।
শুধু একটা কথাই নিশ্চিতভাবে জানে সবাই, অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন ফুটবলের পসরা সাজিয়ে বসবে দুটি দল। আর তাতে জয় হবে ফুটবলের।