আশির দশকের সেরা একাদশ বাছতেই গলদঘর্ম কোনি
জেরেমি কোনি যেন একটু বিপদেই পড়ে গেলেন! ‘বলেন কী, সেই ১৯৭৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সেরা একাদশ! কত বছর হয়, হিসাব করেছেন?’
করেছিই তো! ৪৫ বছর। ‘১৯৭৪ সালে আপনার ক্যারিয়ার শুরু। সেই সময় থেকে গত ৪৫ বছরে যাঁদের সঙ্গে খেলেছেন আর যাঁদের খেলা দেখেছেন, তাঁদের মধ্য থেকে সেরা দল গড়তে হবে’—আমার কথা শুনে জেরেমি কোনি মাথায় হাত দিয়ে ফেললেন, ‘কঠিন, খুবই কঠিন কাজ।’
কঠিন তো বটেই। তবে একই সঙ্গে কি মজারও না! আপনি আপনার চোখে সেরা ১১ জন বেছে নেবেন, সেটা অন্য কারও সঙ্গে না মিললে না মিলবে। একজনের সঙ্গে আরেকজনের মিলবে না বলেই না এই ‘সেরা একাদশ’ ‘সেরা একাদশ’ খেলাটা এত মজার।
জেরেমি কোনি কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘প্রথমে ওপেনার...আমি ব্যারি রিচার্ডসকে নেব, সঙ্গে গর্ডন গ্রিনিজ।’ ব্যারি রিচার্ডস, সুনীল গাভাস্কার না? কোনি একটু থমকে গেলেন, ‘সুনীলকে আমি খুব বেশি দেখিনি...না, এভাবে হবে না। একটু চিন্তাভাবনা করতে হবে। আমি রাতে হোটেলে একাদশটা বানাব। কাল আপনাকে দিয়ে দেব।’
‘কাল’ মানে হ্যামিল্টন টেস্টের তৃতীয় দিন বিকেলে কমেন্ট্রি বক্সের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। রেডিওতে কমেন্ট্রি করছেন অস্ট্রেলিয়ায় নিউজিল্যান্ডকে প্রথম টেস্ট জেতানো অধিনায়ক। হ্যাডলি-ক্রোদের অধিনায়কের আরেকটা বড় কীর্তিও আছে। ইংল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ড প্রথম টেস্ট সিরিজ জিতেছিল তাঁর নেতৃত্বেই। কমেন্ট্রির পালা শেষ করে আমার দিকে চোখ পড়তেই পেছনের টেবিলে রাখা একটা বড় খাতা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। সেই খাতা খুলে বললেন, ‘নামগুলো লিখে নিন। তবে আমি কিন্তু পুরো সময়টার সেরা একাদশ করিনি। শুধু আশির দশকে যাঁরা খেলেছেন, আমার দলে শুধু তাঁরাই আছেন।’
একটু হতাশ হয়ে বললাম, ‘আমি তো আপনি যত দিন ক্রিকেটের সঙ্গে আছেন, এই পুরো সময়ের সেরা একাদশ চেয়েছিলাম।’
কোনি মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘কী করব বলুন! আশির দশকটায় এমন দুর্দান্ত সব ক্রিকেটার ছিলেন যে, তাঁদের মধ্যে ১১ জন বেছে নিতেই আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। কী সব ক্রিকেটারদের বাইরে রাখতে হয়েছে, জানেন—গ্রেগ চ্যাপেল, ক্লাইভ লয়েড, মার্টিন ক্রো, মাইকেল হোল্ডিং...।’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। ১৯৮০-এর দশকের সেরা একাদশ তো করেই ফেলেছেন। ওটা নিয়ে নিই। আজ রাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আপনার খেলা শুরুর সময় থেকে এখন পর্যন্ত সেরা একাদশটা করে ফেলুন। সেটি নিতে আমি আগামীকাল আবার আসব।’
কথামতো পরদিন আবার কমেন্ট্রি বক্সের দরজায়। আজ অন্য দুজন কমেন্ট্রি করছেন, জেরেমি কোনি পেছনে বসে। আমাকে দেখেই উঠে এসে দুঃখিত মুখে জানালেন, কাজটা তিনি করে উঠতে পারেননি। ‘বসেছিলাম একবার, হয়নি। আরও সময় লাগবে। আমার আশির দশকের দলের অনেকেই ওই দলেই থাকবে। কাকে বাদ দেব, এটাই সমস্যা। নতুন অনেকেই তো বিবেচনায় আসবে’—বলার পর কয়েকটি নামও বললেন, ‘ওয়াসিম আকরাম হয়তো আসবে। ওরও আশির দশকেই শুরু, তবে সেরা সময়টা পরের দশকে। শেন ওয়ার্ন আছে। লারা, টেন্ডুলকার, অ্যামব্রোস, ওয়ালশ...। না, এটা করতে সময় লাগবে। আপনি ওয়েলিংটনে যাচ্ছেন তো? সেখানে দিয়ে দেব।’
ওয়েলিংটন টেস্টের প্রথম দুদিন বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ায় জেরেমি কোনির সঙ্গে এখনো দেখাই হয়নি। আপাতত তাই তাঁর নির্বাচিত ১৯৮০-এর দশকের সেরা একাদশটাই জানিয়ে দিই। পরে তাঁর চোখে গত ৪৫ বছরের সেরা একাদশ যদি পাওয়া যায়, তখন দেখা যাবে। তা কোনির আশির দশকের সেরা একাদশে কে কে আছেন? মুখে মুখে বলার সময় প্রথমেই যাঁর নাম বলেছিলেন, দেখা গেল চূড়ান্ত নির্বাচনে সেই ব্যারি রিচার্ডসই বাদ। বললেন কারণটাও, ‘ভেবে দেখলাম, ব্যারি রিচার্ডস মাত্র ৪টা টেস্ট খেলেছে, সুনীল গাভাস্কার যেখানে অনেক দিন ধারাবাহিকতা রেখে খেলে গেছে।’ গাভাস্কার-গ্রিনিজের পর তিন নম্বরে ভিভ রিচার্ডস, এরপর নির্ভেজাল ব্যাটসম্যান বলতে অ্যালান বোর্ডার ও জাভেদ মিয়াঁদাদ। রিচার্ডস ও বোর্ডারের কোনো ব্যাখ্যা দরকার হয় না। কিন্তু গ্রেগ চ্যাপেলকে বাইরে রেখে মিয়াঁদাদ কেন? কারণটা অনুমান করাই যায়। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মিয়াঁদাদের দুর্দান্ত রেকর্ড। ১৮ টেস্টে ৭টি সেঞ্চুরি ও ৬টি হাফ সেঞ্চুরি, ব্যাটিং গড় ৭৯.৯৫। সেঞ্চুরির মধ্যে দুটি আবার ডাবল।
‘আশির দশক ছিল অলরাউন্ডারদের। আমি তাই দুজনকে রাখব’ বলার পর চোখ টিপে বললেন, ‘অন্তত একজন কিউইকে তো রাখতেই হবে—রিচার্ড হ্যাডলি। ওর সঙ্গে থাকবে ইমরান। বোথাম আর কপিলকে রাখতে পারলাম না। তবে বোথাম হবে আমার দলের টুয়েলভথ ম্যান।’ বোলার বেছে নেওয়ার সময় শুধু জোয়েল গার্নারের ক্ষেত্রেই ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন, ‘মাইকেল হোল্ডিংয়ের চেয়েও গার্নারের উইকেট বেশি। আর কী বোলিং গড়!’ কথাটা সত্যি। ৬০ টেস্ট খেলে হোল্ডিং নিয়েছেন ২৪৯ উইকেট। দুই টেস্ট কম খেলেই গার্নার তাঁর চেয়ে ১০ উইকেট বেশি। আর বোলিং গড় তো অবিশ্বাস্য—২০.৯৭।
ব্যাটিংয়ে-বোলিংয়ে জেরেমি কোনির নিউজিল্যান্ড দলের সবচেয়ে বড় দুই তারকার একজন মার্টিন ক্রোকে বাদ দিতে হয়েছে বলে কোনিকে একটু দুঃখিত দেখায়। দুষ্টুমি করে বললেও হ্যাডলিকে যে শুধু ‘কিউই’ বলেই দলে রাখেননি, সেটিও জানিয়ে দেওয়া কর্তব্য মনে করলেন। কোনির অধিনায়কত্বে দিনের পর দিন হ্যাডলির এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স, তাঁকে উদ্দীপ্ত করার কোনো টোটকা কি ছিল? কোনি জানালেন, ছিল, তবে সেটি খুবই সরল, ‘রিচার্ড ছিল পরিসংখ্যান আর রেকর্ডে আচ্ছন্ন। ওকে শুধু বললেই হতো, রিচার্ড, এই মাঠে কারও প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট নেই বা ম্যাচে ১০ উইকেট নেই। ব্যস, ওতেই কাজ হয়ে যেত।’
কাজ যে হয়ে যেত, পরিসংখ্যানেও এর প্রমাণ। কোনির নেতৃত্বে হ্যাডলি যে ১২টি টেস্ট খেলেছেন, তাতে তাঁর বোলিং গড় ১৮.০২। ক্যারিয়ার বোলিং গড় যেখানে ২৩.২৯। পার্থক্যের ছাপ আছে ব্যাটিংয়েও (কোনির নেতৃত্বে গড় ৩৪.৮১. ক্যারিয়ার গড় ২৭.১৬)। হ্যাডলির ইনিংস-সেরা (৯/৫২) এবং ম্যাচসেরা (১৫/১২৩) বোলিংয়ের সময়ও কোনিই নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক। এই দুটি একই টেস্টে। যা আবার কোনির নেতৃত্বে খেলা হ্যাডলির প্রথম টেস্টও! ১৯৮৫ সালের বিখ্যাত সেই ব্রিসবেন টেস্ট। যেটিতে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল নিউজিল্যান্ড।
কোনি-হ্যাডলি রসায়নের কী স্মরণীয় সূচনাই না হয়েছিল!