আমার 'রবি' দেখা
>লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের আনুষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষক স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের উদ্যোগে গতকাল বাংলাদেশে পা রেখেছিলেন ক্লাব কিংবদন্তি রবি ফাওলার। প্রথম আলোকে দেওয়া ১৫ মিনিটের সাক্ষাৎকারে ভক্ত-সমর্থকদের প্রিয় এই ‘ঈশ্বর’ যেন খুলে বসেছিলেন তাঁর স্মৃতির ঝাঁপি!
‘হি ইজ অন হিজ ওয়ে অ্যাগেইন, ইজ দিস গোইং টু বি দ্য হ্যাটট্রিক? ইট কুড স্টিল বি, ইট ইজ! দ্যাটস ইনক্রেডিবল! আনবিলিভেবল স্টাফ ফ্রম লিভারপুল, আনবিলিভেবল স্টাফ ফ্রম রবি ফাওলার!’
বলতে আপত্তি নেই, মার্টিন টাইলার যখন স্কাই স্পোর্টসে রবি ফাওলারের অনন্যসাধারণ কৃতিত্বের জন্য উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন, সে ধারাবিবরণী সরাসরি শোনার বা সে ম্যাচটা সরাসরি দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। তবুও ইউটিউব-ডেইলিমোশানের যুগে সে সময়ের খেলা দেখা, সে যুগের খেলোয়াড়দের চোখ ধাঁধানো নৈপুণ্য প্রত্যক্ষ করা এখন সময়ের ব্যাপার। আমরা পেলে-ম্যারাডোনা-ক্রুইফ-বেকেনবাওয়ারদেরও মোটামুটি এভাবেই চিনেছি, বুঝেছি—তাই না?
আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’ বা আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনার হাত একটা জ্বলন্ত চুলার ওপর ধরে রাখুন, মনে হবে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। কিন্তু একজন সুন্দরী মেয়ের পাশে এক ঘণ্টা বসে থাকুন, আপনার কাছে মনে হবে মাত্র এক মিনিট পার হলো। এটাই আপেক্ষিকতা।’ যুগের পর যুগ পার হয়ে যাওয়ার পরও এর চেয়ে ভালো সংজ্ঞা কেন বের হয়নি, সেটি বোঝা গেল কাল।
কৃতিত্বটা যে ‘অনন্যসাধারণ’ সেটা বলতেই হবে। ডেভিড সিম্যানের মতো কিংবদন্তি গোলরক্ষক, মার্টিন কেওনের মতো কিংবদন্তি ডিফেন্ডারকে আপনি ৪ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডের মধ্যে টানা তিনবার পরাস্ত হতে সচরাচর দেখবেন না। হালের মেসি-রোনালদোরও এমন কৃতিত্ব নেই। আর্সেনালের মতো পরাশক্তির বিপক্ষে ৪ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে হ্যাটট্রিক করে রাতারাতি তারকা বনে গিয়েছিলেন রবি ফাওলার। ‘তারকা’ বলাটা হয়তো কমই হবে। অ্যানফিল্ডের ভক্ত-সমর্থকেরা আদর করে তাদের এই তুখোড় গোলশিকারির ডাকনাম যে ‘ঈশ্বর’ রেখেছে! সেটা অবশ্যই মজা করে। মাঠে ফাওলারের একের পর এক অবিশ্বাস্য কীর্তি দেখে, মুগ্ধতার বশে। মাঠে ফাওলারের খেলা দেখে বোঝার জো ছিল না, গোল করার কাজটা যে আসলে কতটা কঠিন!
সে ‘ঈশ্বর’কে সরাসরি দেশের মাটিতে দেখার অভাবনীয় সুযোগটা করে দিল স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। লিভারপুলের ভক্ত-সমর্থকদের সঙ্গে দেখা করার জন্য লিভারপুলের কিংবদন্তিরা বিভিন্ন দেশে যাবেন, ক্লাবের আনুষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষক হওয়ার সুবিধার্থে লিভারপুলের সঙ্গে এমন এক চুক্তিই করে রেখেছে তারা। একই প্রকল্পের আওতায় গত বছর আরেক কিংবদন্তি জন বার্নসকেও বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিল তারা।
রবি ফাওলারের পরিচয় আরেকটু খোলাসা করে বলা যাক। শুধু একটা হ্যাটট্রিকের নিক্তিতে ফাওলারকে মাপাটা ভুল হবে। ১৯৭৫ সালের ৯ এপ্রিলে জন্ম নেওয়া এই তারকা লিভারপুলের ঘরের ছেলে। স্কুলের এক ম্যাচে চার হালি গোল করার কৃতিত্ব ছিল তাঁর, ম্যাচে ফাওলারের দল ‘থরভেল্ড’ জিতেছিল ২৬-০ গোলে! গোল করার অদম্য সেই ক্ষুধা দেখেই বোধ হয় ১৭ বছর বয়স হতে না হতেই ফাওলারকে তাড়াতাড়ি নিজেদের একাডেমিতে নিয়ে আসে লিভারপুল। লিভারপুলের হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবারের মতো মাঠে নামেন ১৯৯৩ সালে, ফুলহামের বিপক্ষে। এর পরের গল্পটা শুধুই ওপরে ওঠার। ১৬৩ গোল করে প্রিমিয়ার লিগের ষষ্ঠ সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। ওপরে শুধুই অ্যালান শিয়ারার, ওয়েইন রুনি, অ্যান্ডি কোল, ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড আর থিয়েরি অঁরি। নয়টা হ্যাটট্রিক করে প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হ্যাটট্রিকের মালিকও এই স্ট্রাইকার।
আক্ষরিক অর্থেই ফাওলার বসেছিলেন দুই ইঞ্চি দূরত্বে। সাক্ষাৎকারের আগেভাগে তাই বলে নিলাম, ‘আগে থেকেই বলে নিচ্ছি, আপনাকে দেখে আমি অভিভূত। জানি না কীভাবে আমার মুখ থেকে কথা বেরোবে, সাক্ষাৎকার নেওয়া তো দূরের কথা!’
অভিভূত ভক্তের দেখা পাওয়ার ঘটনা অবশ্যই এই প্রথম নয়, ফাওলার তাই মুচকি হেসে জানালেন, ‘চিন্তা কোরো না। ধীরেসুস্থে প্রশ্ন করো। আমি তোমাদের মতোই সাধারণ একজন!’
ক্যারিয়ারজুড়ে লিগামেন্টের চোট যন্ত্রণা না দিলে হয়তো প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় প্রথমেই জ্বলজ্বল করত তাঁর নাম। এ চোটের কাছে বশ মেনে যুগে যুগে ফর্ম হারিয়েছেন রবার্তো বাজ্জিও, রয় কিন, মার্কো রয়েস, রাদামেল ফ্যালকাও, রুড ফন নিস্টলরয়, রবার্ট পিরেস, মাইকেল ওয়েনের মতো তারকারা। এই চোটে পড়েই হয়তো অনুচ্চারে ফাওলার জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি আসলেই ‘ঈশ্বর’ নন। আমাদের মতোই রক্ত-মাংসে গড়া একজন মানুষ। গতকাল সাক্ষাৎকারেও চলে এল এই ডাকনামের বিষয়টা। অ্যানফিল্ডের ভক্ত-সমর্থকেরা আদর করে ‘ঈশ্বর’ ডাকনাম দিয়েছে, ফাওলারের নিজের কেমন লাগে ব্যাপারটা?
‘আমি আর বাকি সবার মতোই। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলতে চেয়েছি। লিভারপুলের স্থানীয় একজন সন্তান হিসেবে পরিচিত হতে চেয়েছি, যে ফুটবল খেলতে চাইত। যার সৌভাগ্য হয়েছিল লিভারপুলের জার্সি গায়ে কিছু ম্যাচ খেলার, কিছু গোল করার। খেলোয়াড় হিসেবে হোক বা মানুষ হিসেবে, আমি আর দশজনের মতোই সাধারণ একজন!’
পুরোদস্তুর সুযোগসন্ধানী স্ট্রাইকার যাকে বলে, তা-ই ছিলেন ফাউলার। প্রশ্নটা তাই অবধারিত, ‘আদর্শ নম্বর নাইন বলতে যা আমরা বুঝি, আপনি ঠিক তাই-ই ছিলেন পুরো ক্যারিয়ারে। ইয়ান রাশ চলে যাওয়ার পর আক্ষরিক অর্থেই “নম্বর নাইন” জার্সিটা তুলে দেওয়া হয় আপনাকে। আপনার পর লিভারপুলে অনেক “নম্বর নাইন” খেলে গিয়েছেন। যেমন ফার্নান্দো তোরেস, জিব্রিল সিসে। এখন খেলছেন ব্রাজিলের তারকা স্ট্রাইকার রবার্তো ফিরমিনো। এঁদের মধ্যে কার খেলা দেখে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছেন আপনি?’
প্রশ্ন শুনে খুশি হলেও উত্তরে রাখলেন পেশাদারির ছাপ। নির্দিষ্ট কারওর নাম উল্লেখ করলেন না, ‘আমি আসলে বিষয়টাকে এভাবে দেখি না। আমার কাছে জার্সির পেছনের নম্বরটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ জার্সির সামনের যে ব্যাজটার জন্য আমরা খেলি, সেটা (বুকে থাকা লিভারপুলের ব্যাজ “লিভারবার্ড”-এর দিকে ইঙ্গিত করে)। আমরা সবাই এই ব্যাজটার জন্যই মাঠে আমাদের সর্বস্ব নিংড়ে দিই। দলের জন্য সর্বোচ্চ ভালো ফলাফল নিয়ে আসার চেষ্টা করি।’
লিভারপুলের এই দল থেকে কোনো একজন খেলোয়াড়কে যদি নিজের দলে নিতে পারতেন, তাহলে কোন খেলোয়াড়কে নিতেন ফাওলার? নিজের মতো আক্রমণভাগের কোনো খেলোয়াড়কে না বেছে নিয়ে বর্তমানে লিভারপুল রক্ষণভাগের সবচেয়ে তারকা ভার্জিল ফন ডাইককে চাইলেন, ‘কোনো একজন খেলোয়াড়কে যদি আমি আমার দলে নিতে পারতাম, আমি ফন ডাইকের নাম বলব। লিভারপুলে ফন ডাইকের আগেও অনেক বিশ্বমানের সেন্টারব্যাক খেলে গেছে। যেমন জেমি ক্যারাঘার, সামি হুপিয়া, স্টেফানে হেনচোজ। সবার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমার কাছে মনে হয় ফন ডাইক এমন একজন ডিফেন্ডার, যে কি না শুধু একটা ম্যাচ নয়, বরং একটা শিরোপা জিতিয়ে দিতে পারে। অসাধারণ মানের একজন ডিফেন্ডার সে।’
ফাওলারকে কি কখনো লিভারপুলের ডাগ আউটে দেখা যাবে? কোচ হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও এখনই লিভারপুলের কোচ হতে চান না, ‘আমি লিভারপুলের কোচ হতে চাই না, সেটা বলব না। কিন্তু আমি চাই যত দিন ইউর্গেন কে রাখা সম্ভব হয়, ও-ই আমাদের ম্যানেজার হিসেবে থাকুক। অনবদ্য একজন ম্যানেজার সে। যেমন ম্যানেজারের অধীনে লিভারপুলের মতো ক্লাবের থাকা উচিত, ঠিক তেমন।’
সামনের সপ্তাহে নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী এভারটনের সঙ্গে ম্যাচ খেলবে লিভারপুল, প্রতিপক্ষের মাঠে। ম্যাচটা দেখতে যাবেন তো ফাওলার? ‘আমি চাইব ম্যাচটা দেখতে। রোববার সকালের মধ্যেই আমার লিভারপুলে পৌঁছানোর কথা। পৌঁছেই সন্ধ্যায় ম্যাচটা দেখতে চলে যাব।’ এভারটনের বিপক্ষে তিনি নিজেও তো বেশ কিছু ম্যাচ খেলেছেন। লিভারপুল শহরের ‘নীল’ দলের বিপক্ষে খেলতে নেমে ১৫ ম্যাচে গোল করেছেন ৬টা। লিভারপুলের একাডেমিতে ভর্তি হওয়ার আগে নিজেও আরেক কিংবদন্তি জেইমি ক্যারাঘারের মতো এভারটনের ভক্ত ছিলেন। এভারটনের মাঠে গিয়ে গোল করতে কেমন লাগত ফাওলারের?
‘প্রতি মৌসুম শুরুর আগে যখন সময়সূচি দেওয়া হতো, আমি আগ্রহভরে জানতে চাইতাম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আর এভারটনের ম্যাচগুলো কবে হবে। আমি লিভারপুলের স্থানীয়, তাই এসব ম্যাচ খেলার জন্য আমার মধ্যে একটা বাড়তি উত্তেজনা কাজ করত। লিভারপুল শহরে এক পরিবার এভারটন সমর্থন করছে তো ঠিক তার পাশের বাড়ির লোকজন লিভারপুল সমর্থন করছে। এটা অনেকটা বন্ধুত্বপূর্ণ বৈরিতার মতো। তাই সব সময় যে এভারটনের সঙ্গে ডার্বি খেলার অভিজ্ঞতা সুখকর হতো, তা কিন্তু নয়। আমি ওদের বিপক্ষে বেশ কিছু ম্যাচ জিতেছি। আবার বেশ কিছু ম্যাচ হেরেছিও। এভারটনের সঙ্গে ম্যাচ হারলে মনে হতো, জীবনে খেলা সবচেয়ে জঘন্য ম্যাচ এটা!’
তিনি নিজে একজন কিংবদন্তি। ক্যারিয়ারজুড়ে খেলেছেন অনেক কিংবদন্তির সঙ্গে, অনেক কিংবদন্তি কোচের অধীনে শিখেছেন বহু কিছু। এঁদের মধ্যে ফাওলারের প্রিয় কোচ কে? যে কোচের অধীনে ফাওলারের তারকাখ্যাতি আকাশ ছুঁয়েছিল, তাঁকেই বেছে নিলেন, ‘পুরো ক্যারিয়ারে বেশ কিছু অসাধারণ কোচের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এদের মধ্যে কাউকে বেছে নিতে হলে আমি এভান্সকেই বেছে নেব। এভান্স একজন অসাধারণ ম্যানেজার ছিল। খেলোয়াড়দের সঙ্গে মিশে যেতে পারত। ফুটবল ম্যানেজার হিসেবে এভান্সের কৌশল ও প্রজ্ঞার কথা অনেক কম আলোচিত হলেও আমি বলতে পারি, রাফার (বেনিতেজ) থেকে ওর কৌশলগত জ্ঞান বেশি বৈ কম ছিল না।’
ফাওলারের প্রিয় কোচ এভান্স, জানা গেল। কিন্তু সতীর্থ? ক্যারিয়ারে অনেক ভালো খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলা ফাওলার সবচেয়ে প্রিয় সতীর্থ হিসেবে কাকে বেছে নেবেন? বেছে নিলেন প্রিয় দুই সতীর্থ জন বার্নস ও স্টিভ ম্যাকম্যানামানকে, ‘অনেক ভালো খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ইয়ান রাশ, স্টিভ ম্যাকমানামান, জন বার্নস। আমি যখন খেলি, তখন বার্নস সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হয়ে গিয়েছিল। সে লেফট উইংয়েও অসাধারণ খেলত, সম্ভবত লেফট উইংয়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় বলা যায় তাকে। আর ম্যাকম্যানামানের প্রতিভা সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। ম্যাকমানামান আর বার্নস, এ দুজনের সঙ্গে খেলেই বেশি তৃপ্তি পেয়েছি আমি।’
শুরুতে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব কপচানো হয়েছিল। কারণটা এবার ব্যাখ্যা করা যাক। ফাওলারের সঙ্গে একান্তে কথা বলার জন্য কপালে ১৫ মিনিট জুটেছিল। সেটা কীভাবে কোন দিক দিয়ে উড়ে চলে গেল, টেরই পাওয়া গেল না। প্রিয় মানুষের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটালেই মনে হয় মাত্র কিছুক্ষণ কাটালাম, আর এ তো সবে ১৫ মিনিট! এই কয়েক মুহূর্তসম অভিজ্ঞতার শেষে সঙ্গী হলো কিংবদন্তির প্রতি একরাশ মুগ্ধতা, ভালো লাগা।