জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও এক পেসার, কেন এত নেতিবাচক আমরা?
>জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আজ সিলেটে ১ পেসার নিয়ে খেলেছে বাংলাদেশ। আমরা বড় দল হয়ে উঠতে চাই, বিদেশের মাটিতে টেস্ট জিততে চাই। কিন্তু জিম্বাবুয়ের মতো দলের বিপক্ষে এক পেসার খেলাই পরিকল্পনা করেই। তবে কি আমরা নিজেদের গণ্ডির বাইরে যেতে ভয় পাই? ফাস্ট বোলিং-কিংবদন্তি কোর্টনি ওয়ালশ যে দলের বোলিং কোচ, সে দল দুই পেসার নিয়ে টেস্টে নামতে সাহস পায় না, এটা কি লজ্জার নয়?
এমসিসি সর্বশেষ বাংলাদেশে এসেছিল ২০০০ সালে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনন্য অবদান রাখা মেরলিবোন ক্রিকেট ক্লাব সেবার নিজেরাই একটি অনন্য অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়েছিল। বাংলাদেশের মূল ক্রিকেটাররা সবাই ধর্মঘটে গিয়েছিলেন দাবি আদায়ের জন্য। এমন অবস্থায় তড়িঘড়ি করে একটি দল বানিয়ে এমসিসির বিপক্ষে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। ঢাকা মেট্রোপলিটনের নাম নিয়ে এমসিসির বিপক্ষে তিন দিনের ম্যাচটা ড্রও করে এসেছিল সে দল।
প্রায় ১৯ বছর পুরোনো এক স্মৃতি নিয়ে টানাটানি কেন—এ প্রশ্ন জাগছে? উত্তর মিলবে শিগগিরই। কোনোমতে দাঁড় করানো সে দলে পেস বোলার ছিলেন একজন। আশফাক আলী, যদিও স্থানীয় ক্রিকেট তাঁকে রাহাদ নামেই চিনত। প্রথম ইনিংসে ৪ উইকেট নিয়ে ভালোই করেছিলেন রাহাদ। দলে তাঁর সঙ্গে নতুন বলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন অধিনায়ক মাহফুজুর রহমান। সেটা নতুন বলে অন্য প্রান্তে বল করতে হবে বলেই। টুকটুকে লাল বলটা হাতে নেওয়ার মতো গতি কিংবা দক্ষতা কোনোটাই ছিল না তাঁর। অফ স্টাম্পের বাইরে নিরাপদ করিডরে ব্যাটসম্যানের সঙ্গে ‘তুমি ওখানে, আমি এখানে’ ধরনের বল করে হাঁপ ছেড়েছেন।
আরিফুল হক অমন করেননি। তাঁর বলের গতিও মাহফুজুরের চেয়ে যথেষ্ট ভালো। নিরাপদে বল করার দিকেও মনোযোগ না দিয়ে লাইন লেংথ মেনে ভালোই করেছেন। তবু আরিফু্লের চেয়ে মাহফুজুরকে ভাগ্যবান মানতে হচ্ছে। কারণ, অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে হলেও নতুন বলটা ধরার সৌভাগ্য হয়েছিল মাহফুজুরের। ৯ ওভার বলও করেছিলেন প্রথম ইনিংসে। কিন্তু আরিফুল একটি টেস্ট দলের দ্বিতীয় পেস বোলিং ভরসা হয়েও প্রথম দিনের আর্দ্রতা মাখা উইকেটে নতুন বল হাতে পাননি। পুরো দিনের ৯১ ওভারে তাঁর ভাগ্যে জুটেছে মাত্র ৪ ওভার।
বাংলাদেশ দলের দ্বিতীয় পেস বোলিং ভরসা আরিফুল, এটুকু পড়েই (বা লিখে) থেমে যাওয়া উচিত ছিল। দুর্দান্ত গতির জন্য না খালেদ আহমেদ নামে একজনকে ডেকে আনলেন নির্বাচকেরা। মোস্তাফিজুর রহমান ও শফিউল ইসলাম নামে দুজন অভিজ্ঞ (আবু জায়েদের তুলনায়) পেসারও আছেন দলে। এরা গেলেন কোথায়?
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সর্বোচ্চ শক্তির দল নিয়ে নামার ঘোষণা দিয়েছিলেন কোচ রোডস। আজ সকালে দেখা গেল সর্বোচ্চ শক্তির সে দল মানে এক পেসার ও তিন স্পিনার। টিম ম্যানেজমেন্ট যতই আরিফুলকে পেস বোলিং অলরাউন্ডার বলে নির্বাচনকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে চান, প্রথম দিনে দুটি নতুন বল একবারও তাঁর হাতে না দিয়ে অধিনায়ক প্রমাণ করে দিয়েছেন আরিফুল দলে আছেন ‘দ্রুত কিছু রান তোলার’ জন্যই। প্রধান নির্বাচক স্কোয়াডে আরিফুলের জায়গা পাওয়ার সময় শেষ দিকে দ্রুত রান তোলার গুণের কথাটাই প্রথমে উল্লেখ করেছিলেন, সেটাই দলে সুযোগ পাওয়ার পথ খুলে দিয়েছে তাঁর। অর্থাৎ বাংলাদেশ আদতেই এক পেসার নিয়ে নেমেছে আজ।
এমন নয় যে বাংলাদেশ এই প্রথম এক পেসার নিয়ে নেমেছে। দেশের মাটিতে টেস্টে প্রথম দৈত্য বধ, অর্থাৎ ইংল্যান্ডকে ২০১৬ সালে হারানো হয়েছিল এই রেসিপিতেই। ভয়ংকর স্পিন-বান্ধব সে উইকেটে ১০৮ রানের দুর্দান্ত এক জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। সিরিজের প্রথম টেস্টে মাত্র ২০ রানে হেরে যাওয়া ম্যাচে দুই পেসারের প্রায় ‘শূন্য’ অবদানেই সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেটা পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে স্বচ্ছন্দ ইংলিশদের বিপক্ষে ভালো কাজে দিয়েছে।
ওহ, বাংলাদেশ কিন্তু দেশের মাঠে আরও একটি ঐতিহাসিক জয় পেয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। মজার ব্যাপার সে ম্যাচে কিন্তু দুজন পেসার মাঠে ছিলেন। আর সিরিজের পরের টেস্টে, চট্টগ্রামে এক পেসার নিয়ে নেমেও উল্টো হেরে বসেছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এক পেসার নিয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও খেলেছে, স্বাগতিক হিসেবে সর্বশেষ সিরিজে। ঢাকার উইকেটে দুই ইনিংসেই ব্যাটসম্যানরা প্রতিপক্ষের অর্ধেক করেই হাঁপিয়ে ওঠায় বোলিংয়ের সে পরিকল্পনা মাঠে মারা গেছে।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এমন কিছু হবে এটা বলা বাড়াবাড়ি। কোচের কাছে যদি জয়ের সহজ সমীকরণ হিসেবে এক পেসার তত্ত্বই প্রাধান্য পায়, তবে এ নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় না। হাজার হলেও নিজেদের মাঠে নিজেদের শক্তিই তো কাজে লাগাতে চাইবে স্বাগতিক দল। কিন্তু হাতের নাগালে থাকা কিছু তথ্য আরেকবার বিবেচনা করা যাক।
দেশের মাটিতে খেলছে বাংলাদেশ। ওয়ানডে সিরিজে অনায়াস জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। সিরিজে জিম্বাবুয়ের চেয়ে বাংলাদেশের পেসারদের খারাপ মনে হয়নি এক মুহূর্তের জন্য। আর বর্তমানে দুই দলের শক্তিমত্তার যে অবস্থা, তাতে জিম্বাবুয়েকে হারাতে স্পিন উইকেট বানিয়ে স্পিনার লেলিয়ে দিতে হয়, সেটি মেনে নেওয়াটাও কঠিন। মোস্তাফিজ, শফিউল কিংবা স্কোয়াডে না থাকা রুবেল, ইবাদত সম্ভবত জারভিস, চাতারার চেয়ে ভালো পেসার।
এবার একটু দূর অতীত ও নিকট ভবিষ্যতে নজর দেওয়া যাক। গত দুই বছরে বাংলাদেশ তিনটি পূর্ণাঙ্গ সফরে গিয়েছে। নিউজিল্যান্ডের পর দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজ—প্রতিটি সফরেই টেস্টে পেস বোলিংয়ের সামনে বাংলাদেশের ব্যাটিং ছিল আতঙ্কিত। ব্যাটসম্যানরা গতি ও সুইংয়ের সামনে অসহায় হয়ে পড়ছিলেন। অসহায় বোধ করেছেন দেশের অগণিত ক্রিকেটপ্রেমীও। দেশের মাটিতে এক পেসার খেলানোর অভ্যাস আর সে ধরনের উইকেটে খেলা ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে এর চেয়ে বাড়তি কিছু চাওয়াও অন্যায়। কাঁধের ওপর দিয়ে বল যেতেই তো দেখেন না তাঁরা। নিউজিল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটে গিয়ে তাঁরা টিকবেন কীভাবে!
আগামী বছরই বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে ভালো করতে চাইলে দ্রুত গতির পেসারদের গুরুত্ব দিতেই হবে। ইদানীং আইসিসির টুর্নামেন্টে ব্যাটিং সহায়ক উইকেট বানানোর নির্দেশনা থাকে। ফলে পরিচিত সুইং নির্ভর ইংলিশ উইকেট হয়তো দেখা যাবে না। কিন্তু এমন উইকেটেও যাদের বলে বাড়তি গতি ও বাউন্স থাকে তাঁরা সাফল্য পান। প্রত্যেকটি দল এ কারণে নতুন নতুন পেসার খুঁজে বের করছে। বাংলাদেশও নিশ্চয় সে পথে আছে। খালেদ আহমেদের অন্তর্ভুক্তি তো সে কথাই বলে। কিন্তু জিম্বাবুয়ের মতো দলের বিপক্ষেও যদি স্পিন বান্ধব উইকেট বানিয়ে মাত্র একজন পেসারকে খেলার সুযোগ দেওয়া হয়, তবে আর তরুণ পেসারদের উন্নতি কীভাবে হবে?
কোর্টনি ওয়ালশ যে দলের পেস বোলিং কোচ, সে দল এখনো দুজন পেসার খেলাতে সাহস পায় না। এতে আমাদের দুঃখ পাওয়া উচিত, নাকি লজ্জা?