ধন্যবাদ, রাজিন সালেহ!

>সিলেট থেকেই ক্রিকেটকে বিদায় বললেন সিলেটের ছেলে রাজিন সালেহ

বিদায় বলা কেন এত কষ্টের! কেন ধরে আসে গলা! কেন কেঁপে যায় স্বর! কেন চোখে আসে জল!

১৮ বছর, কম সময় তো নয়। মায়ার শিকড় কত দিকে ছড়িয়ে যায়, হুট করে উপড়ে ফেলা তো কষ্টের। রাজিন সালেহ তাই কাঁদলেন। সিলেটে, তাঁর শহরে প্রথম টেস্ট হচ্ছে। রাজিন এই সময়কেই বেছে নিলেন বিদায় বলে দেওয়ার জন্য। আড়ম্বরপূর্ণ কোনো বিদায় নয়, তাঁর জন্য বাড়তি কোনো আয়োজন নেই। আজ লাঞ্চ বিরতিতে এসেছিলেন সাংবাদিকদের কাছ থেকে বিদায় নিতে। ধন্যবাদ জানাতে।

তখনই জানিয়ে দিলেন, পেশাদার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের এ-ই শেষ। মাঠের মানুষ, বিদায় নিতে চান সবুজ ঘাস আর ২২ গজের ধূসর উইকেটের কাছ থেকেও।পরশু  কক্সবাজারে শুরু জাতীয় ক্রিকেট লিগের সিলেট বনাম ঢাকা ম্যাচ হয়ে যাচ্ছে তাঁর শেষ। এরপর? ক্রিকেটের সঙ্গেই হয়তো জড়িয়ে থাকবেন। সিলেটে নিজের একাডেমি বানিয়েছেন। বাংলাদেশ জাতীয় দলকে যতটা দেওয়ার ছিল, তা হয়ে ওঠেনি। অপূর্ণ স্বপ্ন বয়ে বেড়ানো একজন বাবার মতো রাজিনও নিজের একাডেমির সন্তানদের দিয়ে পূরণ করতে চান সেই শূন্যতা।

১০ বছর আগে সর্বশেষ টেস্ট খেলেছেন, ওয়ানডের খাতায় বাতিল হয়েছিলেন এরও দুই বছর আগে। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই যার আগমনধ্বনি শোনা যাচ্ছিল, সেই রাজিন কেন ২৬ টেস্টের ক্যারিয়ারে ১১৪৬ রানে শেষ হয়ে গেলেন কোনো সেঞ্চুরি ছাড়াই? এই প্রশ্ন এখন করেইবা কী লাভ। ৪৩ ওয়ানডেতে ১০০৫ রান, চব্বিশের কাছাকাছি গড়ের চেয়েও বড় চোখে লাগত ৫৫-র কাছাকাছি স্ট্রাইক রেট। একমাত্র আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি অবশ্য ওয়ানডেতেই, বাংলাদেশের পক্ষেই সেটি ছিল মেহরাব ও আশরাফুলের পর তৃতীয় সেঞ্চুরি। ৮৯ ইনিংসের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মাত্র ৮টি ছক্কা বলে দিচ্ছে, রাজিন কখনোই সেই ব্যাটসম্যান ছিলেন না, যার জন্য দর্শকেরা গলা ফাটায়।

কিন্তু পরিসংখ্যানই কি সব? হোয়াট দে ডু নো অব ক্রিকেট হু অনলি নো স্ট্যাটিসটিকস? পরিসংখ্যানে লেখা নেই, ভীষণ অপ্রস্তুত অবস্থায় এক চিলতে পুকুর থেকে টেস্ট ক্রিকেটের মহাসমুদ্রে নেমে খাবি খেতে থাকা বাংলাদেশের সেই সময়টায় রাজিন কীভাবে বুক পেতে নিয়েছেন শোয়েব আখতার নামের এক গতিদানবের খুনে বাউন্সার। দলের প্রয়োজনে কীভাবে শরীরটাকে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে ডাক করে গেছেন একের পর এক বল। কীভাবে নিজের অভিষেক টেস্টেই ২৯১ মিনিটের দীর্ঘ এক ইনিংস খেলেছিলেন করাচিতে। সময় বিবেচনায় যেটি তখন বাংলাদেশের তৃতীয় দীর্ঘতম ইনিংস ছিল।

রাজিন সালেহ
রাজিন সালেহ

আজ পেছন ফিরে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, রাজিনের ভাগ্যলিপি যেন লেখা হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টেই। যে টেস্টে দ্বাদশ খেলোয়াড় রাজিন, বদলি ফিল্ডার হিসেবে নেমে শর্ট লেগে শচীন টেন্ডুলকারের দারুণ এক ক্যাচ নেওয়া রাজিন চিরকালই এমন দ্বাদশ রয়ে গেলেন। কখনো একাদশে থেকেও একজন আউট সাইডার।

পেছনে সাদা পোশাকে যুযুধান জিম্বাবুয়ে-বাংলাদেশকে রেখে রাজিন যখন বিদায় বলছেন, অনেকে হয়তো ভুলেই গেছেন, বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয় আর টেস্ট সিরিজ জয়ের অন্যতম নায়ক এই রাজিনই; জিম্বাবুয়েরই বিপক্ষে এসেছিল যে অর্জন। বাংলাদেশ নিজেরাই যখন টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের সামর্থ্য নিয়ে সংশয়ে ভুগতে শুরু করেছে, সেই সময় এসেছিল এই জোড়া জয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটের বাঁক বদলের যে কয়টা মুহূর্ত হাতে গুণে বলে দেওয়া যায়, ২০০৫-এর সেই সিরিজটি তার অন্যতম।

সেই সিরিজে প্রথম টেস্টে প্রথম ইনিংসে রাজিনের ৮৯, হাবিবুলের সঙ্গে ১১৯ রানের জুটি বাংলাদেশকে সে সময়ে তাদের ইনিংস সর্বোচ্চ ৪৮৮ রানই শুধু এনে দেয়নি, হয়তো ঠিক করে দিয়েছিল সিরিজের গতিপথও। ফিরতি টেস্টে জিম্বাবুয়ে যখন জয়ে ফিরতে মরিয়া, আর বাংলাদেশ মরিয়া টেস্ট ড্র করে সিরিজ জিততে; তখন সবচেয়ে বড় ভরসার নাম হয়ে উঠেছিলেন রাজিন।

যে রাজিন বেশি ধীরে খেলেন বলে, ব্যাটিংয়ে গ্ল্যামারের চেয়ে ঢের বেশি গ্রামার বলে অনেকের মন জিততে পারেননি; তাঁর সেই ঠুকঠুক ব্যাটিংটাই না হলে হয়তো বাংলাদেশ ম্যাচটা বাঁচাতে পারত না। ৫ উইকেট হারিয়ে শঙ্কায় পড়ে যাওয়া বাংলাদেশকে রাজিন সেদিন ১৪০ বলে ৫৬ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন; অথচ আর একটা উইকেট পড়লেই বেরিয়ে পড়ত বাংলাদেশের ইনিংসের লেজ। শেষ দিনের শেষ বিকেলে ষষ্ঠ উইকেটে খালেদ মাসুদকে নিয়ে পার করে দিয়েছিলেন মহামূল্য ২২টি দীর্ঘ ওভার।

রাজিনের ক্যারিয়ারেরও হয়তো ঘুরে যাওয়ার কথা ছিল এর পর থেকে। অথচ নিজের সেরা সময়টা যখন পেতে শুরু করেছিলেন, ২০০৬ সালের মার্চে কেনিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে সেঞ্চুরি, এপ্রিলে তখনকার মহা পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টানা দুই টেস্টে ফিফটি; ওই বছরটাই রাজিনের ক্যারিয়ারের অর্ধেক মৃত্যু লেখা হয়ে গেল। ২০০৬-এর পর যে আর ওয়ানডেই খেলা হয়নি। অথচ নিজের শেষ ওয়ানডে সিরিজের আগের সিরিজেও বাংলাদেশের পক্ষে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান ছিল তাঁর। জিম্বাবুয়ে সফরে। এরপর থেকে ওয়ানডেতে অনিয়মিত হয়ে গেলেন। ২০০৭ বিশ্বকাপের দলে থেকেও একটি ম্যাচও খেলার সুযোগ হলো না। রাজিন বার্তা পেয়ে গেলেন, ওয়ানডে ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁকে আর বিবেচনা করা হচ্ছে না। নিজের শেষ ৬ টেস্ট ইনিংসের চারটিতে শূন্য মেরে মৃত্যুই ঘটে গেল আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের।

অনেকের চোখে গল্পটা সেখানেই শেষ। কিন্তু তা হলে আর এটা রাজিনের গল্প কী করে হয়? রাজিন লড়াইটা তবু ছাড়লেন না। জাতীয় দলে ফেরার ক্ষীণতম আশা বুকে নিয়ে এর পরও ১০ বছর ধরে খেলে গেলেন ঘরোয়া ক্রিকেট। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ রানের মালিকের সবচেয়ে বড় লড়াইয়ের গল্পটা হয়তো এখানেই। ২৪ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেও ক্রিকেটটা না ছাড়া!

শোয়েব আখতারের আততায়ী বাউন্সার বুক পেতে নেওয়ার চেয়েও এই সাহসটা কি কম?

এক নজরে রাজিন সালেহ:

সংস্করণ

ম্যাচ

ইনিংস

রান

গড়

সর্বোচ্চ

সেঞ্চুরি

ফিফটি

টেষ্ট

২৪

৪৬

১১৪১

২৫.৯৩

৮৯

ওয়ানডে

৪৩

৪৩

১০০৫

২৩.৯২

১০৮*

প্রথম শ্রেণি

১৪৭

২৫৪

৮৩২৭

৩৫.৭৩

২০১*

১৮

৪২