মাঠের বাইরে রুশদের অন্য চমক
বিশ্বকাপে স্বাগতিক দেশ রাশিয়া খেলার মাঠে একের পর এক চমক দিয়েই যাচ্ছে। রাশিয়ার খেলা দেখে অনেকে হয়তো নতুন করে দলটির ভক্ত হয়েছেন, রুশ দলের খেলোয়াড়দের খোঁজখবর নিচ্ছেন। ভালোবেসে ফেলেছেন রাশিয়াকে। খেলার মাঠে চেরশিভ আর গোলুভিনদের কাছে এমন প্রত্যাশা রুশদেরও ছিল না। এবার মাঠের বাইরেও চমক দেখাচ্ছেন সাধারণ রুশরা।
রুশদের আতিথেয়তা আর বিশ্বকাপের পরিপাটি আয়োজন মুগ্ধ করেছে বিদেশিদের। বিশ্বকাপ দেখতে রাশিয়ায় আসা একাধিক বিদেশি ফুটবল-ভক্ত প্রথম আলোকে এ কথা জানান।
রাশিয়া বিশ্বকাপের অন্যতম আয়োজক শহর সোচি। বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ের চারটি খেলা এখানে হবে। অলিম্পিক শহর হিসেবে পরিচিতি পাওয়া কৃষ্ণসাগরের তীরে অবস্থিত সোচির ফিশত স্টেডিয়ামে আজ শনিবার স্থানীয় সময় রাত ৯টায় গ্রুপ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ খেলায় জার্মানি খেলবে সুইডেনের বিপক্ষে। মাঠে গিয়ে খেলাটি দেখতে তাই মস্কো থেকে ২১ জুন ফিফার বিশেষ ট্রেনে আমরা রওনা দিলাম সোচির উদ্দেশে। এবারই প্রথম বিশ্বকাপের এক ভেন্যু থেকে অন্য ভেন্যুতে বিনা টিকিটে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় রেলওয়ে বিভাগ ‘এরঝেদে’ দর্শকদের ট্রেনে যাতায়াত ব্যবস্থার দায়িত্ব পালন করছে। বিদেশিদের কাছে দারুণ প্রশংসা পেয়েছে ফিফার এই ‘ফ্রি রাইড’ সেবা। মস্কোর কাজানস্কি রেলস্টেশন থেকে রাতে ফিফার যে ট্রেনটি সোচির উদ্দেশে ছেড়ে যায়, এতে সুইডেন, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রে, আলজেরিয়া, ভিয়েতনাম, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক ছিলেন।
৩০ ঘণ্টার ওই ম্যারাথন ট্রেনযাত্রায় কথা হয় বিশ্বকাপ, রাশিয়া-বহির্বিশ্ব সম্পর্ক, বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে রাশিয়া—এমন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বেশ কয়েকজন বিদেশির সঙ্গে।
ফুয়াদ মেক্সিকাইন এসেছেন আলজেরিয়ার আলজির শহর থেকে। কর্মরত আছেন কাতার এয়ারওয়েজের বিক্রয় সহকারী পদে। অনেকের মতো তিনিও সোচি এসেছেন আজকের খেলাটি দেখতে। বিশ্বকাপের খেলা দেখতে রাশিয়ায় আসার পরের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বিমানবন্দর থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সব স্থানেই দেখা মিলবে বিশ্বকাপের স্বেচ্ছাসেবকদের। অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে আপনাকে সবকিছু ব্যাখ্যা করবে। আপনাকে কোনো কিছু খুঁজে পেতে কষ্ট করতে হবে না। তাঁরা হাসিমুখে সেবা দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। শুধু স্বেচ্ছাসেবকেরাই নন, সাধারণ রুশরাও রাস্তাঘাট চিনিয়ে দিতে সহযোগিতা করছেন। আর প্রয়োজনীয় নিদের্শনাগুলো রুশ ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতে তো রয়েছেই।
সুইডেনের গুটেনবার্গ থেকে আট-নয় বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে বিশ্বকাপের খেলা দেখতে এসেছেন অ্যাক্সেল সেভেন্সটাম। রাশিয়ায় এটিই তাঁর প্রথম সফর। খেলা দেখার পাশাপাশি মেয়েকে নিয়ে রাশিয়ার কয়েকটি শহরে বেড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। অ্যাক্সেলের সঙ্গে কথা হয় ট্রেনের ক্যাফেতে বসে। রাশিয়ায় কেমন লাগছে, জানতে চাইলে অ্যাক্সেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘দারুণ ভালো লাগছে। দেখুন, পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে “রাশিয়াফোবিয়া” বিরাজ করছে। সুইডেনসহ গোটা ইউরোপীয় গণমাধ্যমে রাশিয়া-ইইউ সম্পর্ক নিয়ে একপ্রকার টানাহেঁচড়া খেলা চলছে। যে কারণে ওই সব দেশের সাধারণ জনগণ রাশিয়া সফর করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।’
অ্যাক্সেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাশিয়ায় বেড়াতে আসার পরিকল্পনা ছিল দীর্ঘদিনের। কিন্তু ব্যাটে-বলে না হওয়ায় আগে আসা হয়ে ওঠেনি; তাই এবার বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে রাশিয়ায় বেড়াতে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন।
অ্যাক্সেল বলেন, ‘আমারা ৩০ ঘণ্টা ট্রেনে ছিলাম। ট্রেনের প্রধান কর্মকর্তা আমাদের কামরায় এসে জানতে চাইলেন, আমাদের ট্রেনযাত্রা কেমন হচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না। বগির যাত্রীসেবায় যিনি নিয়োজিত আছেন, তিনি আমাদের দেখভাল করেছেন কি না, আরও কত কী। মস্কো এসে আমরা যে হোটেলে উঠেছি, সেখানেও রুশদের কাছ থেকে এই ধরনের সহযোগিতা পেয়েছি। বাড়িতে অতিথি এলে যে বাড়তি একটা যত্ন করা হয়, আমরা রাশিয়ায় এসে সেটাই পাচ্ছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জার্মানির আরেক নাগরিক তো বলেই ফেললেন, ‘রাশিয়াকে নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে শুধু মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালানো হয়, রাশিয়ায় বেড়াতে না এলে ওই প্রোপাগান্ডাই আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে।’
একটি বেসরকারি কারখানার জেনারেল ম্যানেজার পদে কর্মরত আছেন লেভ। বিশ্বকাপের খেলা দেখতে দুই মেয়েসহ ক্রাসনাদার থেকে সপরিবারে সোচি এসেছেন। সোচি ফ্যান ফেস্টের বাইরে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। প্রথম আলোকে লেভ বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই বিশ্বকাপের স্বপ্ন দেখতাম যে কোনো একদিন বিশ্বকাপের খেলা মাঠে গিয়ে দেখব। আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে বিশ্বকাপের সূচিতে দাগ কাটতাম যে কোন দল কত গোলে জিতবে। আর আজ সেই বিশ্বকাপের আসর আমাদের ঘরেই বসেছে। সেই ছোটবেলার স্বপ্নটা আজ সত্যি হলো।’
প্রথম আলোকে লেভ বলেন, ‘বিশ্বকাপ শুরুর আগে নানা আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে রাশিয়াকে কোণঠাসা করে রাখারও পরিকল্পনা করা হয়। কয়েকটি দল রাশিয়া বিশ্বকাপ বয়কট করারও হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বরাবরই খেলাধুলাকে রাজনীতির বাইরে রাখার পক্ষেই ছিলেন। বিশ্বকাপের মাধ্যমে বিশ্ব জেনেছে যে রাশিয়ায় ভালো ও খোলা মনের মানুষ রয়েছে, যারা কিনা শান্তিতে বসবাস করতে চায় এবং অন্য জাতি ও দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। আমরা শান্তিপ্রিয় জাতি এবং অন্য বর্ণ, ধর্ম ও জাতির মানুষকে আমরা ভালোবাসি।’