জার্মান ট্যাকটিকস কেন এত সফল?
>এবারের শীর্ষ ৫ দলের ফুটবলীয় কৌশল, ছক, গেম প্ল্যান নিয়ে ধারাবাহিকের তৃতীয় পর্ব আজ। লিখেছেন হাসান জামিলুর রহমান
বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তারা। রাশিয়া বিশ্বকাপ জিতে সর্বোচ্চ পাঁচবার বিশ্বজয়ী দল ব্রাজিলের কীর্তি ধরে ফেলার সুযোগ। সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে ডাই মানশাফটরা। জার্মানির দায়িত্বে এবারও থাকছেন জোয়াকিম লো। ২০০৬ সালে দলের দায়িত্ব নেওয়া লোর কোচ হিসেবে এটি তৃতীয় বিশ্বকাপ।
টানা দ্বিতীয়বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে জার্মানি তাকিয়ে আছে লোর দিকে। লোও নিশ্চয় তাঁরই ছক আঁকছেন। এবার জিতলে যে ভিত্তরিও পোজ্জোর পর মাত্র দ্বিতীয় কোচ হিসেবে দুটি বিশ্বকাপ জেতার কীর্তি হয়ে যাবে।
তাঁর কৌশল নিয়ে কখনোই সংশয় ছিল না। যান্ত্রিক জার্মান ফুটবলকে প্রাণের ছোঁয়া দিয়েছিলেন ইয়ুর্গেন ক্লিন্সমান। সেটিতে শিল্প যোগ করেছেন লো। যে জার্মানির খেলা একসময় একঘেয়ে লাগত, সেই জার্মানিই এক যুগ ধরে মন ভরানো ফুটবল খেলে আসছে।
এর নেপথ্যে রয়েছে লোর ৪-২-৩-১ ফরমেশন, যার মেরুদণ্ড ও হৃৎপিণ্ড দুজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার। লোরও দারুণ ভাগ্য, এই দলে রয়েছেন টনি ক্রুস। জার্মান ফুটবলের জন্য যিনি আশীর্বাদ। ক্রুস একটা পাস ভুল দিলে সেটি আরেকবার চোখ কচলে দেখতে হয় বিশ্বাস করার জন্য। মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্যে তাঁকে টেক্কা দেওয়ার মতো কেউ বর্তমান ফুটবল বিশ্বে নেই। পুরো দলের সুতো গাঁথার গুরুদায়িত্ব বর্তাবে ক্রুসের ওপরই।
ক্রুস যেন অর্কেস্ট্রার কন্ডাক্টর। তাঁর নিজের খেলার গতির ওপর নির্ভর করবে জার্মানির খেলার গতি। ক্রুস যেমন ধীর, শান্ত ফুটবল খেলতে পারেন, প্রয়োজনে গতি বাড়ানোর কাজটিও করেন দারুণ নৈপুণ্যের সঙ্গে। মিডফিল্ডের আরেকজন স্যামি খেদিরা। ক্রসের মতো সৃষ্টিশীল নন, তবে রক্ষণে সহায়তা করার পাশাপাশি আক্রমণেও ভূমিকা রাখেন খেদিরা। মাঝমাঠে তাঁর শারীরিক শক্তি জার্মানির জন্য মারণাস্ত্র হতে যাচ্ছে। লোর কৌশলের মূলেও থাকবেন এই দুই মিডফিল্ডারই।
প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ভাঙতে লো ভরসা রাখবেন দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত সৈনিক মেসুত ওজিলের ওপর। আগের সেই দুর্দান্ত ফর্ম না থাকলেও নিজের দিনে ওজিল পুরো ডিফেন্স ধসিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। ড্রিবলিং, ডিফেন্স-চেরা পাস, গোল স্কোরিং সক্ষমতা নিয়ে ওজিল ক্ল্যাসিক্যাল ঘরানার মিডফিল্ডার, যা ডিফেন্সিভ দলগুলোর বিপক্ষে লোর বড় অস্ত্র হতে যাচ্ছে।
জার্মানির আক্রমণভাগের সবচেয়ে বড় ভরসা টমাস মুলার। দুই বিশ্বকাপে ১০ গোল করা মুলারের সামনে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার সুযোগ, যেটি লুফে নিতে মুখিয়ে তিনি নিজেও। পজিশন অনুযায়ী একজন উইঙ্গার হলেও মুলারকে বেশির ভাগ সময় প্রতিপক্ষের ডি-বক্সের আশপাশেই দেখা যায়। সুযোগসন্ধানী মুলারের গোল করার দক্ষতা জার্মানির অন্যতম শক্তির জায়গা। নিজের উইং পজিশন থেকে ডি-বক্সে মুলারের মাপা ক্রস করার সামর্থ্যও প্রশ্নাতীত।
জার্মানির এবারের তুরুপের তাস হতে যাচ্ছেন মার্কো রিউস। স্বয়ং জার্মানদের মতেই গত ২০ বছরে রিউসই তাঁদের সবচেয়ে মেধাবী খেলোয়াড়। ইনজুরির পর ইনজুরির হানায় ৮ বছরে রিউস মাত্র ৩০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে পেরেছেন। ইনজুরির জন্য ছিলেন না ২০১৪ বিশ্বকাপ এবং ২০১৬ ইউরোর দলেও। এবারও ক্লাব মৌসুমের শুরুর দিকটা খেলতে পারেননি। কিন্তু সর্বোচ্চ ফিটনেস ধরে রেখেই বিশ্বকাপে এসেছেন জার্মান সেনসেশন। উইং ধরে তাঁর ড্রিবলিং, গতি যেকোনো ডিফেন্স চুরমার করে দিতে পারে। দারুণ পজিশনিং সেন্সের সঙ্গে দুর্দান্ত ফিনিশিং মিলিয়ে রিউস পরিপূর্ণ প্যাকেজ। জার্মানির বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা এবার অনেকটাই নির্ভর করবে রিউসের ফর্মের ওপর।
স্ট্রাইকার হিসেবে থাকবেন টিমো ভেরনার। বয়স মাত্র ২২ হলেও ভেরনারের খেলায় পরিপক্বতার ছাপ স্পষ্ট। মিরোস্লাভ ক্লোসার মতো কিংবদন্তির জুতোয় পা গলাচ্ছেন। গোল করার সামর্থ্য নিয়ে নেই কোনো প্রশ্ন। হেড, দুই পায়েই শুটিংয়ে দক্ষ ওয়ার্নারই হতে যাচ্ছেন লোর গোলমেশিন।
জার্মানির রক্ষণভাগ বিশ্বকাপেরই সেরা রক্ষণভাগগুলোর অন্যতম। রক্ষণের নেতা ম্যাটস হামেলস। একজন ডিফেন্ডারের যেসব স্কিল থাকা জরুরি, তার সবকিছুই আছে হামেলসের মধ্যে। হামেলসের সঙ্গে জুটি বাঁধবেন জেরোম বোয়াটেং। একই ক্লাবে খেলার কারণে হামেলস-বোয়াটেংয়ের বোঝাপড়াও দারুণ, যা জার্মানির জন্য বাড়তি সুবিধা।
রক্ষণের ডান পাশে বিশ্বকাপজয়ী কিংবদন্তি অধিনায়ক ফিলিপ লামের অভাব পূরণ করার সব সামর্থ্যই রয়েছে জোসুয়া কিমিচের। পেপ গার্দিওলা কিমিচকে জার্মান ফুটবলের সেরা রত্ন হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। রক্ষণ, আক্রমণ দুই ক্ষেত্রেই সমান পটু কিমিচ, যা ডান দিকে জার্মানিকে করেছে শক্তিশালী।
আদতে লেখাটি জার্মানির ফরমেশনের সুবিধা-অসুবিধা দুটো নিয়েই। তবে জার্মানির দুর্বলতা খুঁজে বের করা কঠিন বটে। প্রায় নিখুঁত একটি দল, দুর্দান্ত একজন ম্যানেজার, অসাধারণ খেলার কৌশল মিলিয়ে জার্মানরা এবারও বিশ্বকাপের দাবিদার।
দুর্বলতার কথা যদি বলতেই হয়, বলতে হবে রক্ষণের বাঁ দিকের কথা। জোনাস হেক্টর কিংবা মারভিন প্ল্যাটেনহার্ট বিশ্বমানের নন। প্রতিপক্ষ দল যদি জার্মানির রক্ষণকে বিপদে ফেলতে চায়, বাঁ দিক ব্যবহার করেই করতে চাইবে। কিন্তু সব বাধা পেরিয়ে এসে শেষ দেয়াল হিসেবে চীনের মহাপ্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যানুয়েল নয়্যারকে পরাস্ত করা সম্ভব হবে কি না, সেটিও ভাবনার। তর্কাতীতভাবেই তাঁর প্রজন্মের সেরা গোলরক্ষক। ৮ মাসের ইনজুরি শেষে ফিরে এলেও নয়্যারের ওপরই আস্থা রাখবেন জোয়াকিম লো। তবে এটি জার্মানির জন্য বিপরীত ফলও এনে দিতে পারে।
জার্মানির সবচেয়ে বড় সুবিধাই তারা একজনের দল নয়। প্রতিটি পজিশনের প্রতিটি খেলোয়াড় সমান গুরুত্বপূর্ণ, যা এবারের বিশ্বকাপে খুব কম দলের সম্পর্কেই বলা যায়। এই ব্যতিক্রমই জার্মানিকে করে তুলেছে আরও ভয়ংকর। সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ।
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে যত মাতামাতিই হোক না কেন, এবারের বিশ্বকাপে জার্মানিকে থামানোই হবে সবচেয়ে কঠিন কাজ। প্রস্তুতি ম্যাচের ফল দেখে এখনো আশা ছেড়ে দিলে আপনি কিন্তু সেই বোকার দলেই!
আরও পড়ুন...
আর্জেন্টিনার ট্যাকটিকস নিয়ে বিশ্লেষণ
ব্রাজিলের ট্যাকটিকস নিয়ে বিশ্লেষণ