হাসি-কান্নার রঙ্গমঞ্চ লুঝনিকি প্রস্তুত
ওভারকোটের বুক খোলা। ডান হাতটা বুকে ঠেকানো। ডান দিকের কোন সুদূরে যেন তাঁর দৃষ্টিনিক্ষেপ। এটি একটি পাথরে খোদিত ভাস্কর্য, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের। লুঝনিকি স্টেডিয়ামের পরিচিতির প্রধানতম সূত্রই রাশিয়ার মহান নেতা লেনিনের এই ভাস্কর্য।
আগের দিন পরিচয়পত্র জোগাড় করা হয়েছিল এই স্টেডিয়াম কমপ্লেক্সের বাইরের একটি অফিসে। ভেতরে ঢোকার অনুমতি ছিল না, এ জন্য ‘মহামতি লেনিন’ ছিলেন দৃষ্টির আড়ালে। গতকাল স্টেডিয়াম উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে গণমাধ্যমের জন্য। আর তাতেই সামনে চলে এল লেনিনের মূর্তি।
যেহেতু আগে স্টেডিয়ামের নাম ছিল সেন্ট্রাল লেনিন স্টেডিয়াম, মূর্তিটির অধিষ্ঠান এখানে উচিতই ছিল। উচিত-অনুচিতের ব্যাপার পরে, তবে যে বদলের ধাক্কা সোভিয়েত রাশিয়ার ওপর দিয়ে গেছে, তাতে ১৯৯২ সালে স্টেডিয়ামটি নাম ধারণ করেছে লুঝনিকি স্টেডিয়াম। ভাগ্য ভালো লেনিনের মূর্তিটি সরে যায়নি। অবশ্য তাতে কী আর আসে যায়। ১৯৫৬ সালে লেনিন স্টেডিয়াম নামে এটি নির্মিত হওয়ার ৩২ বছর আগেই লেনিন অন্য ভুবনের বাসিন্দা। ১৯৯২ সালে স্টেডিয়ামের নাম বদলের খবরও তো তাঁর কাছে অজানা!
তবে যে বিষয়টি সারা বিশ্বের জানা এবং সবচেয়ে বিজ্ঞাপিত, তা হলো লুঝনিকি স্টেডিয়াম এবার বিশ্বকাপের রাজপ্রাসাদ। এটির সামনে একটা বড় সাইনবোর্ডের ভাষাটা এমন—প্যালেস অব স্পোর্ট (খেলার রাজপ্রাসাদ)। রাজপ্রাসাদই তো। প্রায় অর্ধেকেরও বড় বিশ্ব মস্কো ১৯৮০ অলিম্পিক বয়কট করেছিল, সেই অলিম্পিকের প্রধান স্টেডিয়াম ছিল এখানেই, হয়েছিল উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠান। এরপর সবচেয়ে গর্বের অনুষ্ঠান ২০০৮ উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল, যাতে মুখোমুখি হয়েছিল দুই ইংলিশ ক্লাব চেলসি ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। অনেক অপেক্ষার পর আরেকটি বিশাল আয়োজন বুকে ঠাঁই দিতে চলেছে লুঝনিকি—বিশ্বকাপ ফুটবল।
২০১৩ থেকে ২০১৭—চার বছর ধরে এই উপলক্ষের জন্য সেজেছে লুঝনিকি। আসনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮১ হাজার। এটি এখন ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ স্টেডিয়াম। এটা হওয়া অবশ৵ম্ভাবীও ছিল। এটাই যে রাশিয়া বিশ্বকাপের হাসি-কান্নার সবচেয়ে বড় রঙ্গমঞ্চ হতে চলেছে। শুরু হবে এখানে, শেষের বাঁশিও বাজবে এখানে। এই দুই ম্যাচের বাইরে আরও পাঁচ ম্যাচের আয়োজক লুঝনিকি। গ্রুপ পর্বের তিনটি বাদে দ্বিতীয় রাউন্ডের একটি, দুই সেমিফাইনালের একটি এবং সবশেষে ১৫ জুলাইয়ের ফাইনাল। নকআউট পর্বের তিন ম্যাচ মানে এই স্টেডিয়ামের বেশিটাই আরও ঝকঝক করবে প্রাপ্তির আনন্দে, আর তারই কোনায় কোনায় দাগ পড়বে কান্নার, জমা হবে অশ্রুর।
লুঝনিকির নামকরণ হয়েছে একদম হাত বাড়ানো দূর দিয়ে বয়ে চলা মস্কোভা নদী-তীরবর্তী পললভূমি থেকে। এখন দেখতে শান্ত নদীটি একসময় দুকূল উপচে পড়ত। প্লাবিত হতো আশপাশের জমি। সেই থেকেই জায়গাটির নাম লুঝনিকি-প্লাবিত ভূমি। লুঝনিকির পলল কোন দলকে যে সবচেয়ে শক্ত ঠাঁই দেবে!
স্টেডিয়াম খুলেছে সকাল ১০টায়, আর প্রথম প্রহরের যাত্রী বলেই একটু বাড়তি কিছু দেখার সুযোগ মিলল। সরাসরি ঢুকে পা ডোবানো গেল কৃত্রিম সবুজ ঘাসের বুকে। ঘুরে দেখা গেল লকার রুম, মিক্সড জোন (খেলোয়াড়দের গমনাগমনের পথের পাশে সংবাদকর্মীদের জন্য ঘেরা জায়গা)।
১৪ জুন এই ঘাসেই প্রথম পা ফেলবে ২১তম বিশ্বকাপ মানে, স্বাগতিক রাশিয়া ও সৌদি আরব মুখোমুখি হবে উদ্বোধনী ম্যাচে। তারপর...পায়ে পায়ে লেখা হবে কত জয় আর পরাজয়ের কাহিনি। এই লকার রুমেই বসবেন মেসি-রোনালদো-নেইমাররা। দুটি লকার রুমের কোনো একটি ১৫ জুলাই ফাইনালের পর হাজার আলোর রোশনাই জ্বালিয়ে লিখবে বিশ্বজয়ের কাহিনি। এই মিক্সড জোন দিয়েই হেঁটে যাবেন বিশ্বসেরা ফুটবলাররা। তাঁদের কারও মুখে থাকবে হাসি, কারও মুখে ঘনাবে আঁধার।
বিশাল কর্মিবাহিনীকে দেখা গেল রঙ্গমঞ্চ সাজাতে শেষ সময়ের কাজে ব্যস্ত। সম্প্রচার সংস্থার বাক্সপেটরা-ক্যামেরা এসে জমছে আন্তর্জাতিক সম্প্রচার কেন্দ্রে। এখানে-ওখানে উঁকি মেরে লুঝনিকির চূড়ান্ত প্রস্তুতি দেখতে ভালোই লাগল।
আরও একটা ভালো লাগা অনুভূতি এ জন্য যে কয়েকজন দক্ষিণ আমেরিকান সাংবাদিকের সঙ্গে এই প্রতিনিধি লুঝনিকি স্টেডিয়ামে প্রথমবারের মতো পা ফেলতে পেরেছেন। হয়তো শেষবারের মতোও। নিরাপত্তারক্ষীরা পরিচয়টা ঠিকমতো ঠাহর করতে পারেননি বলেই হয়তো এমন সুযোগ জুটে যাওয়া।
১৪ জুন থেকে যাঁরা মাঠের মধ্যখানে থাকবেন তাঁরা কোনো সুযোগ নিয়ে আসেননি। তাঁরা এসে দাঁড়াবেন অধিকারের গর্বোদ্ধত ভঙ্গিমায়। পায়ে পায়ে বুনে দেবেন ফুটবলের সুষমা।
লুঝনিকি সেই অপেক্ষাতেই সময় গুনছে।