বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিয়েই বিশ্বকাপে

বাংলাদেশের সাবেক কোচ অটো ফিস্টার। এ দেশ থেকে বরখাস্ত হয়েই ১৯৯৮ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পার করেছিলেন সৌদি আরবকে। ২০০৬ সালে জার্মানি বিশ্বকাপে দাঁড়িয়েছিলেন আফ্রিকান দেশ টোগোর ডাগ আউটে। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের সাবেক কোচ অটো ফিস্টার। এ দেশ থেকে বরখাস্ত হয়েই ১৯৯৮ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পার করেছিলেন সৌদি আরবকে। ২০০৬ সালে জার্মানি বিশ্বকাপে দাঁড়িয়েছিলেন আফ্রিকান দেশ টোগোর ডাগ আউটে। ফাইল ছবি
>

বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিয়েছেন অসম্মানের সঙ্গে। কিন্তু অটো ফিস্টার যে কত উঁচু মানের কোচ ছিলেন সেটা তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ১৯৯৮-তে সৌদি আরবকে বিশ্বকাপে নিয়ে যেয়ে। ২০০৬ সালেও তিনি ছিলেন টোগোর কোচ। এমন একজন কোচকে কাজে লাগাতে না পারার ব্যর্থতা সব সময়ই পোড়ায় বাংলাদেশের ফুটবলকে

অটো ফিস্টারকে ভুলে যায়নি বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে যতজন বিদেশি কোচ এসেছেন, তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে এই জার্মান কোচ ছিলেন অন্যতম সেরা। ১৯৯৫ সালে ফিস্টার বাংলাদেশ-জার্মানি সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তির অধীনে জাতীয় দলের কোচ হয়ে এসেছিলেন একেবারেই বিনে পয়সায়। অবশ্য বাংলাদেশে আসার আগেই তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন বিশ্ব যুব ফুটবলে ঘানাকে শিরোপা জিতিয়ে। তাঁর অধীনেই পচানব্বইয়ের শেষের দিকে মিয়ানমারে চার জাতি ফুটবল টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে এই কোচের বিদায়টা হয়েছিল যথারীতি অসম্মানজনকভাবে। অথচ, বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিয়ে এই জার্মানই সৌদি আরবকে নিয়ে গিয়েছিলেন ১৯৯৮ ফ্রান্স বিশ্বকাপে।

বাংলাদেশের পর ফিস্টারকে নিয়োগ দেয় সৌদি আরব ফুটবল ফেডারেশন। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের শেষের দিকে দায়িত্ব নিয়েই বাজিমাত করেছিলেন ফিস্টার। মজার ব্যাপার হচ্ছে ফিস্টার বাছাইপর্বের শুরুতে ছিলেন বাংলাদেশেরই কোচ। মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও চীনা তাইপের সঙ্গে খেলে বাংলাদেশ খুব ভালো করতে পারেনি। ৬ ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ জয় পেয়েছিলে কেবল একটি (চীনা তাইপে)। ফিস্টার সৌদি আরবের দায়িত্ব নেন সাতানব্বইয়ের শেষ দিকে। কাঠমান্ডু সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেওয়ার পরপরই ফিস্টারের চাকরি চলে গিয়েছিল। এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি যোগ দেন সৌদি আরবের কোচ হিসেবে।

বাংলাদেশে থাকতে ফিস্টারের অনেক ক্ষোভ ছিল। সবচেয়ে বড় ক্ষোভ ছিল, নিজের কর্ম হীনতা নিয়েই। দুই বছরের মেয়াদে জাতীয় দলের দায়িত্বের বাইরে তাঁকে কোনো কিছুতেই সেভাবে কাজে লাগাতে পারেনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। এক প্রকার শুয়ে-বসেই তিনি বাংলাদেশের দুই বছর কাটান। অথচ, এই কোচের সুনাম ছিল দারিদ্র্য-পীড়িত আফ্রিকান ফুটবলের খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার। ঘানাকে বিশ্ব যুব ফুটবলে শিরোপা জেতানোর কথা তো আগেই বলা হয়েছে। পাশাপাশি তিনি কাজ করেছেন রুয়ান্ডা, সেনেগাল, আইভরি কোস্ট, জায়ার, ঘানা, টোগো ও ক্যামেরুনের কোচ হিসেবে। ১৯৯৮ সালে সৌদি আরবকে বিশ্বকাপে নিয়ে গেলেও চূড়ান্ত পর্বে ডাগ আউটে দাঁড়ানোর সৌভাগ্য হয়নি ফিস্টারের। সেই আফসোসটা তিনি মেটান ২০০৬ সালের জার্মানি বিশ্বকাপে টোগোর কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।

আরও একবার কোচ হিসেবে বিশ্বকাপের যেতে পারতেন ফিস্টার। ২০১০ সালে তাঁর অধীনেই বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে দুর্দান্ত খেলেছিলেন ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপে যাওয়া হয়নি তাদের। তবে সম্প্রতি তিনি আফগানিস্তানের কোচের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়েছেন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত খেলাপাগল এই দেশটির ফুটবলকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার।

৮১ বছর বয়সেও এখন দারুণ সুস্থ ও সতেজ ফিস্টার। সম্প্রতি প্রথম আলো ডিজিটালের সঙ্গে আলাপে তিনি জানিয়েছেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার পর সৌদি আরবকে বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়াটা তাঁর কোচিং ক্যারিয়ারের বড় ঘটনা, ‘ওটা দারুণ একটা সিদ্ধান্ত ছিল আমার। বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সৌদি আরব আমাকে প্রস্তাব দেয়, সেটা সাতানব্বইয়ের শেষ দিকে। আমি সেই চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করি। সে সময় কোচের চাকরি হিসেবে সৌদি আরব খুব ভালো জায়গা ছিল না। খুব ঘন ঘন তারা কোচ বরখাস্ত করত।’

যে বয়সে মানুষ অবসরে চলে যান। সে বয়সে ফিস্টার একটা জাতীয় ফুটবল দলের কোচের দায়িত্ব পালন করছেন। ৮০ বছর বয়সেও যাকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দিতে সবাই উন্মুখ, যিনি বিশ্বকাপে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁকেই কিনা কর্মহীন বসিয়ে বিদায় করে দিয়েছিল বাংলাদেশের ফুটবল-কর্তারা!

ফুটবলের এই অবস্থা আসলে দীর্ঘ দিনের অনাচারেরই ফসল!