ওরা ভয় দেখানোয় সফল, আমরা ভয় পেয়ে ব্যর্থ
ভয় দেখানোটাই আসল। ভয় পাওয়ানোই জরুরি। আফগানিস্তান এই যে দাপিয়ে খেলছে, প্রথমে প্রস্তুতি ম্যাচ, তারপর তিন ম্যাচের প্রথমটায় এই যেভাবে ছেলেখেলা করে হেলায় জিতল, তার কারণ একটাই। বাংলাদেশকে তারা ভয় দেখাতে পেরেছে এবং বাংলাদেশ ভয় পেয়েছেও। এতটাই ভীত যে নিজেদের স্বাভাবিক খেলাটা তারা খেলতে পারছে না। শুরু থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে।
আফগানিস্তানের সাফল্য এটাই।
রাজনীতিতে বলে, প্রতিপক্ষকে তুমি যত আক্রমণ করবে, তারা তত গুরুত্ব পাবে। কারণ, মানুষ বুঝবে তোমার প্রতিপক্ষ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তুমি বারবার তাকে আলোচনার মধ্যে নিয়ে আসছ। তার সমালোচনা করছ। আঘাত করতে চাইছ। ক্রিকেটও এই নিয়মের বাইরে যে নয়, রশিদ খান ও মুজিবুর রহমানকে দেখে তা বোঝা যাচ্ছে। সিরিজ শুরুর আগে থেকেই বাংলাদেশের সবার মনে এই দুই আফগান যেন সাপের ফণার মতো ছেয়ে গেছে। রশিদ ও মুজিব ছাড়া আর কারও মুখে কোনো নাম নেই। কথা নেই। কী করে এই দুজনকে সামলাতে হবে, সেই চিন্তা বাংলাদেশকে এতটাই গ্রাস করে ফেলেছে যে তাদের স্বাভাবিক ছন্দটাই হারিয়ে গেল। এই চাপ কাটিয়ে বেরোনোটাই এখন আসল চ্যালেঞ্জ।
সিনিয়র খেলোয়াড়েরাও এই ‘লো’ স্পিরিটকে ‘হাই’ করতে বহু সময় সফল ভূমিকা পালন করে থাকেন। ভারতের সুনীল গাভাস্কার, মহিন্দর অমরনাথ, শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলী, ভিভিএস লক্ষ্মণেরা অযাচিতভাবে বহু ক্ষেত্রে বহুজনের মনোবল বাড়াতে এগিয়ে এসেছেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ‘মনোবলবর্ধক বটিকা’। দেশের ক্রিকেট-কর্তাদেরই ঠিক করতে হবে কীভাবে এদিকে নজর ঘোরানো যায়।
রোববার রাতে পোস্ট ম্যাচ প্রেস মিট-এ আসা লিটন দাসকে অসহায়ের মতো লাগছিল। তাঁর কথাবার্তা, ম্যাচ নিয়ে যাবতীয় প্রশ্নের জবাবের মধ্য দিয়ে এই সত্যই বেরিয়ে আসছিল যে রশিদ-মুজিব জোড়া ফলার মোকাবিলা কী করে করা যায়, সেই ধন্দ থেকে তাঁরা কিছুতেই বেরোতে পারছেন না। লিটন তো একসময় বলেই ফেললেন, টি-টোয়েন্টিতে ওই দুজনের চার-চার আট ওভারকে সমীহ করলে হাতে থাকে মাত্র বারোটা ওভার। খেলাটা ওখানেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
লিটনের এই স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রথমত, ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া রশিদ-মুজিব জোড়া ফলার মোকাবিলার কোনো উপায়ের খোঁজ তাঁরা এখনো পাননি। দ্বিতীয়ত, তাঁদের তূণে এমন তির নেই যা আফগানদের ভীত ও সন্ত্রস্ত করে রাখতে পারে।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যও এটাই। এই দলে এমন একজনও নেই আফগানরা যাঁকে কিছুটা হলেও সমীহ করবেন। বাংলা ক্রিকেটের মহিরুহ সাকিব আল হাসান। ১০ হাজার রান ও ৫০০ উইকেট পাওয়ার দোরগোড়ায় তিনি দাঁড়িয়ে। এই পরিসংখ্যান হেলাফেলার নয়। কিন্তু আজ তিনি অতিপরিচিত এক প্রতিবেশী। এত দিন ধরে দেখার ফলে প্রতিপক্ষের কাছে আজ তিনি ‘প্রেডিক্টেবল’। বাংলাদেশের বোলিংও উদ্ভাবনী শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। নতুনভাবে নতুন ঢঙে নতুন কিছু দেওয়ার চমক নেই।
নতুনত্বের এই খরা কাটিয়ে ইদানীং দারুণভাবে উঠে এসেছিলেন একজনই মোস্তাফিজুর রহমান। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, সিরিজ শুরুর আগেই তিনি আহত হলেন। মোস্তাফিজুরের বয়স কম। ফলে শেখার আগ্রহ যথেষ্টই থাকার কথা। প্রয়োজন ঠিকঠাক লালনের। কীভাবে তিনি আরও অনেকের মতো ‘ভয়ের কারণ’ হয়ে উঠতে পারেন, সেই ভাবনা মোস্তাফিজুরের মতো বাংলাদেশের ক্রিকেট-কর্তাদেরও ভাবতে হবে।
বিস্ময় জাগে অন্য একটি ক্ষেত্রেও। কোর্টনি ওয়ালশের মতো এমন একজন ডাকসাইটে ফাস্ট বোলার বোলিং কোচের পাশাপাশি অস্থায়ী হেড কোচের দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পেস বোলিং কেন এত বৈচিত্র্যহীন! কেন প্রতিটি ডেলিভারির মধ্যে সেই ছোবল অনুপস্থিত? ১৩২টা টেস্ট ম্যাচে ৫১৯ উইকেট নেওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়! এক দিনের ক্রিকেটেও তো তাঁর শিকার ২২৭টি! তা হলে কোনটা বিশ্বাস করতে হবে, কোর্টনির নতুন কিছু দেওয়ার নেই, নাকি বাংলাদেশের পেসারদের নতুন কিছু আর শেখার নেই?
রোববার অধিনায়ক সাকিব যে নমুনা রেখেছেন, তাতে সমালোচনা তাঁকে শুনতেই হবে। ছিদ্র দলের সর্বত্র। এত ফাঁকফোকর ভরাট করতে গেলে একতা ও একাগ্রতার প্রয়োজন। আর দরকার অদম্য জেদের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন নবাগত আফগানিস্তান বাংলাদেশের অহংয়ে হেলাফেলায় আঘাত করে যাবে, এই অপমানবোধই তো প্রবল তাগিদের জন্ম দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট!
তাগিদ ও জেদের জোরে মানুষ সর্বোচ্চ শৃঙ্গে গিয়ে পৌঁছায়। সেই তুলনায় আফগানিস্তান তো টিলা! ভয়ডর জয় করে সেই টিলা টপকানোর আশায় সাকিব অ্যান্ড কোং মাঠে নামছেন, মঙ্গলবার তা দেখতেই হাজির হব স্টেডিয়ামে।