আফগানদের প্যাশন আছে, আছে ভালো খেলার তাগিদও
>আফগানিস্তানে ক্রিকেটটা এখনো প্যাশন। অর্থের ঝনঝনানি এখনো সেভাবে শোনা যায়নি। আফগান ক্রিকেটারদের মূল অস্ত্র ‘প্যাশন’ আর ভালো খেলার প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি।
কার্যকারণ খুঁজতে গেলে এভাবে বলা যেতে পারে, ভাগ্যিস আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন ঘটেছিল, ভাগ্যিস সেই যুদ্ধ দীর্ঘ দশ বছর স্থায়ী হয়েছিল, নইলে আফগানরা হয়তো ক্রিকেটকে এভাবে আঁকড়ে ধরত না।
কিন্তু সোভিয়েত আগ্রাসনের সঙ্গে ক্রিকেটের সম্পর্কটা কোথায়? রাশিয়ানরা আর যাই হোক কস্মিনকালেও ক্রিকেটের ধার কাছ দিয়ে হেঁটেছে বলে তো শোনা যায়নি!
লুৎফুল্লা স্টানিকজাইয়ের মুখে মৃদু হাসি। বেতের মতো ছিপছিপে তাঁর শরীর। গায়ের রং দুধে-আলতা। আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের মিডিয়া ও মার্কেটিং প্রধান। এই দেরাদুনে শতাধিক সাংবাদিকের যাবতীয় চাহিদা মেটানোর দায়ও তিনি স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। হেঁয়ালিটা ধরে রেখেই বললেন, ‘১৯৭৯-৮০ সালে সোভিয়েতদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলো। লাখ লাখ লোক উদ্বাস্তু হয়ে খাইবার পাস পেরিয়ে চলে গেল পাকিস্তানে। পেশোয়ারের উপকণ্ঠ ছেয়ে গেল উদ্বাস্তু শিবিরে। আফগান শিশুদের বিনোদনের প্রধান উপায় হয়ে গেল ক্রিকেট।’
ইতিহাস অবশ্য বলছে, ক্রিকেট কী বস্তু তা আফগানরা জেনেছিল সেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে। ইংরেজদের সঙ্গে আফগানিস্তানের যুদ্ধের সময়। সেটা ১৮৩৯ সাল। ইংরেজরা যেখানে গেছে, সেখানেই পুঁতে দিয়ে এসেছে ক্রিকেটের বীজ। সে সময় কাবুলেও তারা ক্রিকেট খেলেছিল। কিন্তু অঙ্কুরিত বীজ চারাগাছও হতে পারেনি। ক্রিকেট ওই দেশে ফিরে আসে তারও দেড় শ বছর পর।
সোভিয়েতদের সঙ্গে দশ বছর লড়াইয়ের পর পাকিস্তান থেকে যাঁরা দেশে ফিরে গেলেন, ছোঁয়াচে রোগের মতো তাঁদের পায়ে-পায়ে আফগানিস্তানে ঢুকে পড়ল ক্রিকেট। দেখতে দেখতে অনাদিকালের ঐতিহ্যবাহী ‘বুজকাশি’ খেলা জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে গেল। জায়গা দখল করে নিল ক্রিকেট। এমনই প্রবল সেই আকর্ষণ যে ১৯৯৫ সালে আফগানিস্তান ক্রিকেট ফেডারেশন তৈরি হলো। পাঁচ বছরের মধ্যে তাকে অনুমোদন দিল ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল বা আইসিসি।
বছরের হিসেব অনুযায়ী যে দেশের ক্রিকেট এখনো শৈশব পেরোয়নি, তারা কীভাবে এতটা সমীহ আদায় করে নিচ্ছে? লুৎফুল্লা একটি শব্দে এই প্রশ্নের জবাব দিয়ে হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইলেন—‘প্যাশন।’
প্যাশন ছাড়া আরও একটি বিষয় আফগানদের রয়েছে। তাগিদ। তাগিদ ভালো খেলার। জেতার। একেবারে নিচ থেকে ওপরে উঠে আসার। এই যে প্যাশন ও তাগিদ তাঁদের তাড়া করে বেড়াতে পারছে, এর অন্য একটা কারণও রয়েছে। আফগান ক্রিকেটে অর্থের ঝনঝনানি এখনো আসেনি। লুৎফুল্লা কথাটা এইভাবে বললেন, ‘আমাদের বোর্ড দরিদ্র। আফগান ক্রিকেটে টাকা নেই। বৈভব নেই। ক্রিকেটকে জীবিকা করার তাগিদ এখনো তালগাছের মতো মাথা ছাড়ায়নি। যা আছে তা ওই প্যাশন। খেলাটাকে ভালোবাসা। বিশ্ব ক্রিকেটের নজরে আসার চেষ্টা। সমীহ আদায়ের তাড়না। ক্রমশই ভালো খেলার বাসনা। নিজেদের প্রমাণ করার অদম্য ইচ্ছাশক্তি। আমরা তাই এভাবে এগোতে পারছি।’
কাবুলে ক্রিকেটের যে স্টেডিয়াম রয়েছে, তা সবচেয়ে পুরোনো। ছোটও। কান্দাহারে ভারত একটা স্টেডিয়াম তৈরি করে দিয়েছে। আফগান সরকার সবচেয়ে ভালো ও আধুনিক এক স্টেডিয়াম তৈরি করছে জালালাবাদে। শেরজাই ক্রিকেট স্টেডিয়াম। কাজ যদিও চলছে ঢিমেতালে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, শেরজাই ক্রিকেট স্টেডিয়াম তৈরি হয়ে গেলে আফগানিস্তান নিজের দেশে আন্তর্জাতিক আসর বসাতে পারবে। লুৎফুল্লার কথায়, ‘সেই পরিস্থিতি আমাদের দেশে কবে আসবে বলতে পারব না। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তা, কোনো দিক থেকেই আমরা প্রস্তুত নই। ভারতকেই আমাদের হোম করে রাখতে হবে।’
তাতে আফগানদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। ভারতে সারা বছর খেলা যাবে। খেলা দেখা যাবে। শেখা যাবে। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড তো এই সিদ্ধান্তের কথাও জানিয়ে দিয়েছে, যে দেশ ভারতে খেলতে আসবে, আফগানিস্তানের সঙ্গে তারা একটা করে অনুশীলন ম্যাচ খেলবে। আফগান ক্রিকেটাররা এই সিদ্ধান্তে খুশি। অধিনায়ক আসগর তা স্বীকারও করে ফেললেন। বললেন, ‘যত খেলব তত শিখব’।
তালেবানরা যখন রাজত্ব করছিল, সেই সময় প্রথম প্রথম ক্রিকেটকে তারা নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু পরে সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। লুৎফুল্লা জানালেন, এখন তো তালেবানরা ক্রিকেটকে সমর্থন করছে। মদদও দিচ্ছে। ক্রিকেটের পক্ষে যেমন মঙ্গল, তেমনই মঙ্গল দেশের পক্ষেও। ক্রিকেটই আফগানিস্তানের একমাত্র ‘ইউনিফাইং ফ্যাক্টর’। দেশের বাইশটা প্রদেশেই আজ ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। ২৫ ওভারের প্রাদেশিক টুর্নামেন্ট হচ্ছে। কাবুলে হয় সেরা ছয় প্রদেশের মধ্যে ৫০ ওভারের টুর্নামেন্ট। তাঁদের লক্ষ্য, বাইশটা প্রদেশেই একটা করে ক্রিকেট স্টেডিয়াম তৈরি করা। আক্ষেপ, ‘বোর্ড যদি একটু ধনী হতো।’
আফগানিস্তানের এই দলের প্রায় সকলেই হিন্দিতে কথা বলতে পারেন। কেউ কেউ ভালো ইংরেজিতেও। হিন্দি জ্ঞানের জন্য লুৎফুল্লা কৃতিত্ব দেন হিন্দি সিনেমা ও গানকে। ‘ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের যোগাযোগ আজকের নয়। বহু বছর ধরেই হিন্দি সিনেমার চল আছে আমাদের দেশে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও আফগানদের একটা বড় ঠিকানা ভারত। পাকিস্তানের লাগোয়া বলে উর্দু ভাষার আমদানিও হয়েছে। শারজা আমাদের হোম গ্রাউন্ড ছিল। সেখানে ভারত-পাকিস্তানিদের ভাষাও হিন্দি। শারজার পর হোম এখন ইন্ডিয়া। হিন্দিই এই দেশের প্রধান লিংক ল্যাঙ্গুয়েজ। ক্রিকেটের মতো ভাষাও আমরা দ্রুত রপ্ত করে ফেলেছি।’
ভালো তাঁরা বেসে ফেলেছেন এই দেরাদুনকেও। পাহাড়ের পায়ের কাছে ছিমছাম স্টেডিয়াম। অধিনায়ক আসগর স্টানিকজাইয়ের সোজাসাপ্টা স্বীকারোক্তি, ‘এখান থেকে তাকালেই কী সুন্দর পাহাড় দেখা যায়। পাহাড় দেখলে মনে হয় এই তো দেশেই আছি।’