মধ্যযুগের উজ্জ্বল কবি ও পালাকার চন্দ্রাবতী। এ দেশে আঞ্চলিক ভাষায় ব্যতিক্রমী রামায়ণপালা-রচয়িতা তিনিই—চন্দ্রাবতী। জন্মেছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারি গ্রামে। তৎকালীন সময়ে এ দেশে যেসব নারী কবিতা লেখার মতো ‘সাহস’ প্রদর্শন করেছিলেন, ইতিহাস বলে, চন্দ্রাবতী তাঁদের মধ্যে প্রথম। পারিবারিক পরিমণ্ডলেই তিনি কাব্যচর্চার পরিবেশ আর অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তাঁর পিতা দ্বিজ বংশীদাশ ছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধের মনসামঙ্গলের কবি। মনসার ভাসান গান গেয়েই সংসার চালাতেন তিনি। চন্দ্রাবতী-রচিত রামায়ণের বন্দনা থেকেই শোনা যাক:
সুলোচনী মাতা বন্দি দ্বিজবংশী পিতা
যার কাছে শুনিয়াছি পুরাণের কথা
মনসা দেবীর বন্দি করি কর জোড়,
যাহার প্রসাদে হলো সর্ব দুঃখ দূর।
চন্দ্রাবতী পিতার সঙ্গে একত্রে মনসার ভাসান গান রচনা করেছেন। গ্রামের সাধারণ মানুষ নিয়ে অসংখ্য গান রচনা করেছেন। বিভিন্ন মেয়েলি ব্রতের ছড়া, প্রাচীন আচার-পদ্ধতি অবলম্বনে বিভিন্ন কবিতাও রচনা করেছেন। সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত তাঁর দস্যু কেনারামের পালা দীনেশচন্দ্র সেনের ময়মনসিংহ গীতিকায় স্থান পেয়েছে। মলুয়া পালাটিও তাঁর রচিত। লোকসাহিত্যের বিশিষ্ট সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে সর্বপ্রথম চন্দ্রাবতীকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন কেদারনাথ মজুমদারের সৌরভ পত্রিকার (১৩২০, বঙ্গাব্দ) মধ্য দিয়ে। ময়মনসিংহ গীতিকায় সংকলিত চন্দ্রাবতীর পালাগুলোও চন্দ্রকুমার দের সংগ্রহ করা।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, আশৈশব খেলার সাথি ও প্রেমিক জয়ানন্দের সঙ্গে চন্দ্রাবতীর যখন বিয়ের কথা চূড়ান্ত, তখন আচমকা চরম প্রতারণার শিকার হতে হয় তাঁকে। তাঁর প্রেমিক জয়ানন্দ ঘটনাচক্রে অন্য নারীকে বিয়ে করে। জীবনের এহেন প্রেম আর প্রতারণার ভার বহন করে চন্দ্রাবতী আজীবন অবিবাহিত থেকে লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। পিতা দ্বিজ বংশীদাশ চন্দ্রাবতীর জন্য এক শিবমন্দির নির্মাণ করে দেন। সেখানে শিবপূজা আর কাব্যসাধনাতেই জীবন কাটান কবি চন্দ্রাবতী। জীবনের একপর্যায়ে তাঁর প্রেমিক জয়ানন্দ নিজের ভুল বুঝতে পারে। চন্দ্রাবতীর কাছে ক্ষমা চাইতে ফিরে আসে জয়ানন্দ। কিন্তু তখন চন্দ্রাবতী এক অন্য মানুষ, ধ্যানস্থ যোগিনী। শিবমন্দিরের বদ্ধ কপাট পেরিয়ে জয়ানন্দের সে ডাক আর তাঁর কানে পৌঁছায় না! ক্ষমালাভে ব্যর্থ জয়ানন্দ আত্মদহনে জর্জরিত হয়ে ফুলেশ্বরী নদীতে আত্মবিসর্জন করে।
কবি চন্দ্রাবতীর ব্যক্তিজীবন অবলম্বন করে পালাকার নয়ানচাঁদ ঘোষ চন্দ্রাবতী নামে একটি গীতিকা-পালা রচনা করেন। সে পালাটিতে উঠে এসেছে চন্দ্রাবতীর জীবনের নানান ঘটনাপ্রবাহ। প্রেমে প্রতারিত হয়ে চন্দ্রাবতী তাঁর পিতাকে নিজের মনোবাসনা প্রকাশ করেন। নয়ানচাঁদের পালা থেকে এ বিষয়ে দুয়েক ছত্র শোনা যাক:
চন্দ্রাবতী বলে পিতা, মম বাক্য ধর
জন্মে না করিব বিয়া রইব আইবর
শিবপূজা করি আমি শিবপদে মতি
দুঃখিনীর কথা রাখ কর অনুমতি।
নয়ানচাঁদ ঘোষের চন্দ্রাবতী নামে এ পালাটি দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত পূর্ববঙ্গ গীতিকায় অন্তর্ভুক্ত। ওই পালাটির মূল কাহিনি অবলম্বনে পরবর্তী সময়ে রচিত হয়েছে শহুরে গীতিনাট্য-পালা চন্দ্রাবতী। আজও ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে চন্দ্রাবতীকে নিয়ে রচিত গীতিনাট্য-পালাগুলো জনপ্রিয়। ওই সব অঞ্চলের নিজস্ব সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে মঞ্চে প্রদর্শিত হয়ে থাকে। মিডিয়ার কল্যাণে চন্দ্রাবতী পালাটি গণমাধ্যমেও উপস্থাপিত হয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলার লোকসাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এই পালা বিশেষভাবে যুক্ত ও সমাদৃত।
>রামায়ণটি তিনি রচনা করেছেন বৃহত্তর ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায়। পড়লে বোঝা যায় এটি একটি নারীবিষয়ক কাব্য এবং নারী শ্রোতার প্রতি উদ্দিষ্ট
ভারতের বিভিন্ন গ্রামে নারীরা যে রামায়ণ গান করেন তা কেবল নারী-সমাজেই প্রচলিত। নারী-সমাজের বাইরে এ রামায়ণ গান গাওয়া হয় না। বাংলা, তেলেগু, মৈথিলী ও মারাঠি ভাষায় গ্রামের নারীরা নিজেরা রামায়ণ গান করে থাকেন। এসব রামায়ণ গানে নারীরা সম্মিলিতভাবে সীতার বয়ানে তাদের নিজেদের দুঃখ-কষ্টের গান গেয়ে থাকেন—কখনো বীজ লাগানোর সময়, কখনো ফসল তোলার সময়, আবার কখনো বা নিজেদের নিজস্ব ঘরোয়া উৎসব-অনুষ্ঠানে। মারাঠি ভাষায় মহারাষ্ট্রের গাঁয়ের নারীদের রামায়ণ গানের সঙ্গে আমাদের দেশের চন্দ্রাবতীর রামায়ণ গানের সবিশেষ মিল পাওয়া যায়। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ গানও একদা নারীরা সম্মিলিতভাবে উপস্থাপন করতেন—যে-গানে ধ্বনিত হতো সীতার মহিমা, সীতার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়। সীতার জন্ম-বিবাহ-সন্তানধারণ-স্বামীপরিত্যক্ত হওয়া, সন্তান নিয়ে একাকী জীবন কাটানো ইত্যাদি। অর্থাৎ একজন নারীর জীবনে যেসব বিষয় প্রায়ই ঘটে থাকে, সেগুলোই এসব রামায়ণ গানে বড় হয়ে এসেছে। এ কারণে সমাজের শোষিত প্রান্তিক নারীরা এই রামায়ণ গানের সঙ্গে সহজেই শামিল হতেন। সীতার কষ্ট-বেদনার সঙ্গে নারীরা তাঁদের নিজেদের দুঃখ-বেদনাকে সীতার বেদনার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করে কাতর হতেন। নারীদের রামায়ণ হয়ে উঠত নারীদের বেদনার ইতিহাস ও নিজস্ব কণ্ঠস্বর।
‘পরিশীলিত’ রামায়ণে কাণ্ড সাতটি, যার একটি উত্তরাকাণ্ড। এই উত্তরাকাণ্ডেই সীতার বনবাস ও তাঁর ধরিত্রী-প্রবেশ ঘটে থাকে। চন্দ্রাবতী এই কাণ্ডটিকেই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন তাঁর রামায়ণে। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ তিন খণ্ডে বিভক্ত। এটিও প্রচলিত অর্থে ঐতিহ্যবিরোধী। প্রথম খণ্ডটি তিনি সীতার জন্মকাহিনির মধ্য দিয়ে শেষ করেছেন। এতে সীতার পৌরাণিক কাহিনি অনুসরণ করা হয়নি। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে দেখা যায়, ‘সীতার বারমাসী’, যেখানে সীতা সখীদের সঙ্গে বসে আছেন, সখীদের কাছে গল্পচ্ছলে বলে চলেছেন তাঁর বাল্যের কথা, বিবাহের কথা, রাবণ কর্তৃক তাঁর হরণের কথা, অশোকবনে তাঁর বন্দীদশার কথা, রামের জন্য তাঁর বিরহকাতরতার কথা, রাম কর্তৃক তাঁর উদ্ধারের কথা এবং অযোধ্যায় তাঁর প্রত্যাবর্তনের কথা। তৃতীয় পরিচ্ছেদে চন্দ্রাবতী ও সীতা উভয়েই কথকের ভূমিকা নিয়েছেন। এ পরিচ্ছেদে কবি তাঁর নিজের অনুভূতি দিয়ে রামায়ণের ঘটনাপ্রবাহকে উপলব্ধি করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে রাম যখন তার বোনের কথায় বিশ্বাস করে সীতাকে সন্দেহ করে চরম ক্রোধে ফেটে পড়ে, তখনকার পরিস্থিতিটি কবি তাঁর নিজের বয়ানে হাজির করেন এভাবে:
বনেতে আগুনি জ্বলে গো
সায়রে ছোটে বান।
উন্মত্ত পাগলপ্রায় গো বসিলেন রাম।।
রাঙ্গা জবা আঁখি রামের গো
শিরে রক্ত উঠে।
নাসিকায় অগ্নিশ্বাস ব্রহ্মরন্ধ্র ফুটে।।
যে আগুন জ্বালাইল আজ গো
কুকুয়া ননদিনী।
সে আগুনে পুড়িবে সীতা গো
সহিত রঘুমনি।।
পুড়িবে অযোধ্যাপুরী গো কিছুদিন পরে।
লক্ষ্মীশূন্য হইয়া রাজ্য গো
যাবে ছারেখারে।।
পরের কথা কানে লইলে গো
নিজের সর্ব্বনাশ।
চন্দ্রাবতী কহে রামের গো
বুদ্ধি হইল নাশ।।
রামের এই চিত্রণ কোথাও নাই—এই চন্দ্রাবতীর রামায়ণ ছাড়া। এ রামায়ণের সর্বত্র কবি কথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন—বিশেষত সীতার দুঃখ-কষ্টে তাঁর কাতরতা এবং রামের প্রতি তাঁর ক্ষোভ নিজের জবানিতে জোরালোভাবে এসেছে। এসব দিক থেকে এই রামায়ণ একেবারেই ভিন্ন চিন্তনের ছাপ রেখেছে।
রামায়ণ শেষ করেছেন তিনি সীতার বনবাসের সূচনার ভেতর দিয়ে। চন্দ্রাবতীর বলার ধরন এখানে একেবারে ভিন্ন। পৌরাণিক রামায়ণে সীতার অগ্নিপরীক্ষার কথা বর্ণনা আছে এবং এ পরীক্ষার মধ্য দিয়েও শেষপর্যন্ত রামকে চরম প্রজাহিতৈষী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন পৌরাণিক রামায়ণকারেরা। কিন্তু চন্দ্রাবতী তাঁর রাম-কাহিনিতে সীতার অগ্নিপরীক্ষার বিষয়টি একেবারেই আনেননি। একজন নারী হিসেবে আরেকজন নারীর অপমানজনক ও লজ্জাজনক পরিস্থিতিকে দর্শকের সামনে নির্লজ্জভাবে দেখাতে চাননি চন্দ্রাবতী। বরং রামের প্রতি তীব্র বিদ্রূপ হেনে তাকে পাষণ্ড ও সন্দেহপ্রবণ স্বামীরূপে দেখিয়েছেন। কোনো রামবন্দনা তিনি করেননি।
রামায়ণটি তিনি রচনা করেছেন বৃহত্তর ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায়। পড়লে বোঝা যায় এটি একটি নারীবিষয়ক কাব্য এবং নারী শ্রোতার প্রতি উদ্দিষ্ট। নারীর কষ্টকেই এ কাব্যে বড় করে দেখানো হয়েছে। এর অনেক অংশে যেখানে সীতা তার কষ্টের কাহিনি বয়ান করেছেন সেখানে চন্দ্রাবতী শুরুই করেছেন ‘শুন সখীজন’ বলে। কবি চন্দ্রাবতী বিরচিত এই স্বতন্ত্র রামায়ণ পালা দীনেশচন্দ্র সেনের পূর্ববঙ্গ গীতিকায় স্থান পেয়েছে।
চন্দ্রাবতী রচিত অন্য দুটি গীতিকা-পালা মলুয়া ও দস্যু কেনারামের পালা গবেষকদের বিশ্লেষণে নানাভাবে প্রশংসিত। মধ্যযুগের এই কবি শুধু তাঁর রচনার জন্যই নয়, তাঁর ব্যক্তিজীবনের ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে রচিত চন্দ্রাবতী পালার মধ্য দিয়ে নিজেও কিংবদন্তি চরিত্র হিসেবে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের লোকমানসে অধিষ্ঠিত। কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারি গ্রামে চন্দ্রাবতীর শিবমন্দিরটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এ বিশিষ্ট কবির বসতবাড়ি ও শিবমন্দিরটি এখনো যথাযথভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়নি। আমরা জাতি হিসেবে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য কখনো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে ও তা সংরক্ষণ করতে শিখিনি। এ লেখার মধ্য দিয়ে আহ্বান জানাই, মধ্যযুগের এই ব্যতিক্রমী কবি চন্দ্রাবতীর বসতবাড়ি ও শিবমন্দির ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে সংরক্ষণ করা হোক।
সুস্মিতা চক্রবর্তী: শিক্ষক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।