এক 'জ্ঞানের ফেরিওয়ালা'র গল্প
এক ক্লান্ত দুপুরের ভাতঘুমটা ভাঙল মুঠোফোনের শব্দে! মুঠোফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এল আমাদের বিভাগেরই সিনিয়র ভাইয়ের কণ্ঠস্বর, ‘শোন, আজকে ডিপার্টমেন্টে নতুন একজন শিক্ষক এসেছেন! আমরা বিকেলে ওনার সঙ্গে দেখা করতে যাব, তৈরি থাকিস!’
নির্ধারিত সময়েই সেই বড় ভাইয়ের সঙ্গেই পৌঁছলাম শহরের কেন্দ্রস্থল আলুপট্টি মোড়ে! রিকশা থেকে নেমে একটু এগোতেই একটা জটলা চোখে পড়ল! দূর থেকেই দেখতে পেলাম একজন মাঝবয়সী লোক হাত নেড়ে নেড়ে কী সব বলছেন আর আমাদের বয়সী বেশ কিছু ছেলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেসব শুনছে। অস্ফুট স্বরে বড় ভাইকে বললাম, ‘দেখছেন ভাই, ফেরিওয়ালার কথায় জাদু আছে বৈকি! ছেলেগুলারে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে কথা দিয়ে!’ বড় ভাই আমার কথা শুনে হাসলেন আর বললেন, ‘আমরা ওই ফেরিওয়ালার কাছেই যাচ্ছি!’
বড় ভাইয়ের কথাটার মর্ম বুঝলাম একটু পরেই! জটলার কাছে যেতেই দেখলাম বেশির ভাগ লোকই আমার পূর্বপরিচিত। জটলার মধ্যমণি লোকটা কে, তা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল—ইনিই পরবর্তী সময় আমার প্রিয় শিক্ষক হয়ে ওঠা ড. সাম্যসাথী ভৌমিক স্যার! সচরাচর ‘শিক্ষক’ কল্পনা করলে যে রাগী, মোটা ফ্রেমের চশমা পরা, চুলে পাক ধরা বয়সী একটা অবয়ব চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তেমনটা নন উনি! মাঝবয়সী, সৌম্য, পরিপাটি একজন ব্যক্তিত্বই দেখতে পেলাম! কিছুক্ষণ পর অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, আমাদের ‘জ্ঞানের ফেরিওয়ালা’র এই ছোট্ট জটলাটায় আটকে গেছি আমিও!
এরপরের একেকটা দিন আমার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল! আমি অত্যন্ত সাহিত্যপ্রিয় ছিলাম, ওনার সংস্পর্শে এসে সেটায় যোগ হলো নতুন উন্মাদনা! তাঁর সাহচর্যে, অনুপ্রেরণায় আমাদের ইংরেজি বিভাগে একে একে প্রকাশ হলো বহুল প্রতীক্ষিত ‘দেয়াল পত্রিকা’, বিভিন্ন সাময়িকী, পুস্তিকা। স্যারের আহ্বানে কলেজের বিভিন্ন বিভাগের বিতর্কপ্রিয় শিক্ষার্থীরা আমাদের বিতর্ক ক্লাবের সদস্য হলো। ক্লাব ফিরে পেল নবযৌবন! স্যারের একেকটা ক্লাস এতটা সাড়া ফেলল যে ক্লাসবিমুখ শিক্ষার্থীরাও ক্লাসমুখী হলো! কলেজ প্রাঙ্গণে প্রতি শুক্রবার স্যারের তত্ত্বাবধানে বসতে শুরু করল কবিতা পাঠের আসর! আর ওই যে আলুপট্টি মোড়ের প্রতিদিনের বিকেলগুলোর আড্ডাটা হয়ে উঠত অলিখিত ক্লাসরুম!
স্যার শুধু শিক্ষক হিসেবেই সেরা ছিলেন না, ছিলেন সেরা মানুষও। কলেজের কেউ একজন কাঁচা হাতে গল্প উপন্যাস লিখেছে, প্রুফ দেখানো দরকার? আছেন সাম্য স্যার! জাতীয় পর্যায়ে কেউ বিতর্ক, গান বা আবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করতে ঢাকা যেতে হবে, অভিভাবকেরা যেতে দিতে চাচ্ছেন না? যাও সাম্যসাথী স্যারের কাছে, যেভাবেই হোক উনি রাজি করাবেনই! দূরে কোথাও শিক্ষা ভ্রমণে কোনো স্যারকে সঙ্গে পাচ্ছো না? সাম্য সারকে গিয়ে ধরো!
স্যারের মানবতাও চোখে পড়ার মতো। আমাদের সহপাঠী ফারুকের মরণব্যাধি ক্যানসার ধরা পড়ল। আর্থিকভাবে তার পরিবার সচ্ছল ছিল না মোটেও! কিন্তু আমরা চোখের সামনে ফারুককে মরতে দিতে চাইনি। কয়েকজন মিলে সাম্য স্যারের দ্বারস্থ হলাম, বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলাম। উনি শুধু আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, পরের দিন কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখলাম উনি নিজ উদ্যোগে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিয়ে এসেছেন। সেখানেও থামেননি তিনি, কলেজের প্রতিটি বিভাগ, ক্লাসরুম চষে বেড়িয়েছেন আমাদের সঙ্গে। খুব বেশি দিন লাগেনি আমাদের কাঙ্ক্ষিত অর্থ সংগ্রহ করতে।
সাম্যসাথী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। বিভিন্ন সময়ই তিনি তাঁর প্রিয় শিক্ষকদের কথা বলতেন। অনেকবারই শুনেছি তাঁর প্রিয় শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম স্যারের কথা, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের কথা! লক্ষ করতাম, সেসব স্যারের কথা বলার সময় সাম্যসাথী স্যারের চোখেমুখে নিগূঢ় শ্রদ্ধাবোধ ও মুগ্ধতা ফুটে উঠত! স্যার প্রায়ই বলতেন, ‘আমি সৌভাগ্যবান, ওনাদের মতো ব্যক্তিত্বকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম!’
সাম্যসাথী স্যার শুধু আমার প্রিয় শিক্ষকই নন, আদর্শ ব্যক্তিও। তিনি সত্য ও সুন্দরের উপাসকও। স্যারকে সামনাসামনি কখনো বলিনি, হয়তো এ লেখাটা ওনার চোখে পড়তে পারে তাই সলাজে বলতে পারি, ‘স্যার একদিন আমিও ক্লাসভর্তি শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে নির্দ্বিধায় বলব, ড. সাম্যসাথী ভৌমিক নামের একজন মহান ব্যক্তিত্বকে আমি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম, আমি সৌভাগ্যবান।’ আর ঠিক সে সময় আমার চোখমুখ জুড়ে ফুটে উঠবে মুগ্ধতা!
স্যার, এ লেখাটা আপনার চরণতলে আমার অর্ঘ্য। আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করি, মুগ্ধতা ছড়াতে থাকুন শতবর্ষ!
লেখক: রাজশাহী কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী