কাঞ্চন স্যার সবখানে বিরাজমান
১৯৭৫ সাল, আমি প্রথম শ্রেণির ছাত্র। আমাদের হেয়াকোঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন নতুন শিক্ষক যোগদান করবেন। ছোট-বড় সবার মুখে মুখে নাম মোহাম্মদ আলী। ডাক নাম কাঞ্চন, আমাদের কাঞ্চন স্যার।
একদিন সকালে সদ্য পাস করা এক টগবগে তরুণ বিদ্যালয়ে এলেন। আমাদের ক্লাস টিচার। ফরসা, মাঝারি গড়নের সাদা হাফ হাতা শার্ট আর পাজামা পরে আসতেন স্কুলে। হাতে বেত, প্রচণ্ড রাগী, ভয়ে আমরা অস্থির। কিন্তু আস্তে আস্তে আমাদের পড়াশোনার পাশাপাশি, পড়াশোনা বাইরে খেলাধুলাসহ সবকিছুতে আমাদের কোচ হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন।
আমি ছিলাম ক্লাস ক্যাপ্টেন। তাই বাড়তি সুযোগ ছিল ক্লাসরুম ছাড়াও টিচার্স রুমে শিক্ষকদের পারস্পরিক সম্পর্ক দেখার, ক্লাসের বাইরে ও শাসনের মাঝে আদর পাওয়ার।
আমার মনে পড়ে সে সময় প্রধান শিক্ষক আবু তালেব স্যার, নুরুল আমিন স্যার, (নতুন স্যার) ও মোহাম্মদ আলী স্যার তিন দিকপাল হেয়াকোঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে এক অজপাড়া গাঁকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য অকৃত্রিম সাধনা করে গেছেন। মূলত তিনজনই এলাকার হওয়ায় যেভাবে দায়িত্ব নিয়ে প্রতিটি ছেলেমেয়েকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন, তা ইতিহাসে বিরল। হেয়াকোঁ এলাকার ঘরে ঘরে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আছেন। আমরা আজ যারাই যে জায়গাই অবস্থান করি না কেন, প্রাথমিক শিক্ষার বনিয়াদ কিন্তু গড়েছিলেন হেয়াকোঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তার এ তিন সফল শিক্ষক।
মোহাম্মদ আলী স্যারের কথায় আসি। তিনি আমার কাছে শুধু আমার শিক্ষকই ছিলেন না, ছিলেন অভিভাবক, গাইড, কোচ, উৎসাহ প্রদানকারী, প্রেরণার উৎস। প্রথম শ্রেণি থেকেই হাতের লেখা সুন্দর করতে হবে। পরিশুদ্ধ পাঠ শেখা, নিয়ম-শৃঙ্খলা, নেতৃত্বদান, খেলাধুলা, সংগীত, নাটক, এমন কোনো ক্ষেত্রে নেই যেখানে মোহাম্মদ আলী স্যারকে পাবেন না। সবখানেই তিনি ছিলেন বিরাজমান।
প্রাইমারি স্কুলের পাঁচ বছরের একটা ছেলেমেয়েকে স্বপ্নের পথে হাঁটতে শেখানো আমার সে শিক্ষক আর নেই। তিনি সবাইকে ছেড়ে ২০১৫ সালের ৮মে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। কিছুই করা হয়নি, বছরে শুধু দুই ঈদে দুবার কদমবুচি ছাড়া। মনে হতো, এতেই যেন সবকিছু পেয়ে গেছেন। ক্লাসে পাঠদান শেষে গাছতলায় শতকিয়া শেখানো, এরপর খেলার মাঠে বেত নিয়ে রেফারির ভূমিকার সঙ্গে কোচও। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ২৬ মার্চকে কেন্দ্র করে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। অসম্ভব সুন্দর গানের গলা ছিল মোহাম্মদ আলী স্যারের। দেশাত্মবোধক, ভাটিয়ালি, পল্লিগীতি, ভাওয়াইয়া, আঞ্চলিক—কোনো গানই যেন ওনার অজানা ছিল না। সব গানের রিহার্সালে ভালো করে শেখানো, নাটক করা ইত্যাদি। মোহাম্মদ আলী স্যার গীতিকার ও সুরকার ছিলেন, একটি আঞ্চলিক গানের। ইউসুফ সে গান গেয়েছিল, ফরিদও সঙ্গে ভাতিজার ভূমিকায় অংশ নিয়েছিল। আমার গানের কলিটি মনে আছে, ‘আঁর ঘরত তোর চাচি এ আঁশ কুরা পাইল্লে’ চাচা-ভাইপোর এ ঘরোয়া কথোপকথনের সংগীত। গীতিকার ও সুরকার ছিলেন মোহাম্মদ আলী স্যার। প্রথম বছর চাচা শুধু ভাতিজাকে দুঃখ বোঝাত, আর ভাতিজা মাথা নাড়ত। পরের বছর দেখি ভাতিজা একটু একটু জবাব দেয়, শুধু ‘জি’ বলে। চাচা যখন বলেন, ‘ও ভাইপোত’, ভাতিজা তখন জবাব দেয় ‘জি’, সুর করে লম্বা টান দিয়ে। আর তখনই দর্শকদের মুহুর্মুহু করতালি আর চিৎকার। অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সে গান। অসংখ্য স্মৃতি আছে আমার এ ব্যক্তিটির সঙ্গে। এত আদর-যত্ন পেয়েছি যে, কখনো বড় ভাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। সমাজের অপরাপর মানুষের কাছে মোহাম্মদ আলী স্যার হয়তো একেকভাবে পরিচিত। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর নিকট হয়তো ওনার ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান বা জায়গা থাকতে পারে। কিন্তু আমার কাছে তা সম্পূর্ণ আলাদা, আমি আমার এ জায়গা কারও সঙ্গে ভাগ কিংবা সমঝোতা করতে মোটেই প্রস্তুত নই।
যে যে ভাবেই মূল্যায়ন করুক না কেন, এ অসাধারণ মেধাবী মানুষটি আমাকে যা দিয়ে গেছেন, তাতে আমি গর্ব করে বলতেই পারি, ‘হ্যাঁ, মোহাম্মদ আলী স্যার আমার প্রাইমারি টিচার। শত সহস্র সশ্রদ্ধ সালাম আপনাকে, স্যার।’
লেখক: একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত