যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম
সেদিন ছিল ২৪ জুন। নয়টায় ক্লাস বলেই সকাল সকাল বাসস্ট্যান্ডে চলে এলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও বাস আসছে না দেখে যখন কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে পড়ি, ঠিক সেই সময় দেখি, ১২ আসনের একটি মাইক্রোবাস চট্টগ্রামের যাত্রী খুঁজছে। এগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ফেনী যাবে কি না। চালক বললেন, ‘ওঠেন।’
উঠে পড়লাম। চালকের পেছনের আসনে তিনজনের বসার জায়গা। সেখানে একজন বসে আছেন। আমি বসলাম বাঁ পাশটায়। গাড়িতে চালকসহ আগে থেকে ছিলেন পাঁচজন। সামনে চালকের পাশে একজন আর আমার পেছনের আসনে দুজন বসা।
গাড়িতে এসি চলছে। বেশ আরামদায়ক পরিবেশ। সবাই চুপচাপ। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। গাড়িতে ওঠার পরই কেন যেন মনে হলো, ভুল করলাম না তো? মনে মনে অপেক্ষা করছি, সামনেই কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, দেখি সেখানে যাত্রী তোলার চেষ্টা করে কি না? চৌদ্দগ্রাম পৌঁছালে গাড়ি থামিয়ে যাত্রীর জন্য ডাকাডাকি করল (যদিও কেউ উঠল না)।
যাত্রী খোঁজাতে মনে হলো, ঠিকই আছি, কিছু ভুল হয়নি। চিওড়া পার হওয়ার পর একজন জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি তো ফেনী নামবেন।’ বললাম, ‘হ্যাঁ।’ এর মিনিট দু-একের মধ্যে পেছনে না তাকিয়েই বুঝতে পারলাম, পেছন থেকে কেউ একজন সামনে আসার চেষ্টা করছেন। মনের ভেতর কু ডাক শুরু হয়ে গেল। বুঝলাম, আজ কিছু হতে চলেছে! ভয়ের একটা শিহরণ সারা শরীরকে তড়িতায়িত করে গেল। মনে মনে অনাহূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পরই লোকটি আমাকে মাঝের আসনের দিকে ঠেলে বসার জায়গা করতে চাইলেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি সামনে নামবেন?’ লোকটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অনেকটা জোর করে আমাকে মাঝে স্যান্ডউইচ বানিয়ে বাঁ পাশে দরজার পাশে বসে পড়লেন। আমার ডান পাশের জন এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। পাশে লোকটি বসতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য আছে আপনি হুন্ডির টাকা নিয়ে যাচ্ছেন।’ আমি বললাম, ‘আমাকে তো গাড়িতে আপনারা জোর করে তোলেননি। আমি নিজেই উঠেছি। আপনাদের এ রকম তথ্য ঠিক নয়। আমার কাছে বিশেষ কোনো টাকা নেই, ব্যাগে আছে শুধু কিছু কাগজপত্র।’
এবার বাঁ পাশের জন বলে উঠলেন, ‘শোনেন, আমরা খারাপ লোক, আপনি যদি সহযোগিতা করেন, তাহলে আপনার কোনো ক্ষতি করব না, আর যদি কিছু করার চেষ্টা করেন, আমরা আপনার চোখে মলম লাগিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেব।’ মাথার ভেতর একটা বিষয়ই কাজ করছিল, যাতে কোনো শারীরিক ক্ষতি না হয়।
গাড়ি চলছে। একজন জানতে চাইলেন, ‘আপনি কী করেন?’ বললাম, শিক্ষকতা।
এর মধ্যে ডান পাশের লোকটি আমার ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে চেইন খুলে দেখছেন ভেতরে কী কী আছে। বললাম, ‘কিছু নেই, আমি দেখাচ্ছি।’ তিনি ধমক দিয়ে বললেন, ‘থামেন, আমিই দেখছি।’ এদিকে বাঁ পাশে বসা লোকটি আমার প্যান্টের সব পকেট হাতড়ে মুঠোফোন, মানিব্যাগ বের করে আনলেন। মানিব্যাগ তন্ন তন্ন করে খুঁজে যেখানে যা টাকা ছিল, সব বের করে নিলেন। তারপর জুতা-মোজা ও দেহের ওপরের অংশও চেক করে দেখলেন। অন্য সময় হলে সুড়সুড়ি লাগত। কিন্তু এখন ভয়ে সেঁধিয়ে গেলাম।
মুঠোফোন হাতে নিয়ে ব্যাটারি খোলার চেষ্টা করা হলো। হতাশ ভঙ্গিতে চেয়ে আছি। খুলতে না পেরে আনলক করতে বলা হলো। করে দিলাম। ফোন হাতে নিয়ে লোকটি বললেন, বিকাশের কোড বলেন। বললাম, আমার বিকাশ অ্যাকাউন্ট নেই। সহজে বিশ্বাস করতে চাইলেন না। মুঠোফোন অন করে দেখালাম, কোনো বিকাশ অ্যাপস নেই। তখন বিশ্বাস করলেন মনে হলো। এরপর মুঠোফোনের পাসওয়ার্ড নিয়ে নিলেন। তিনি একবার খুলে সফল হওয়ার পর সেট থেকে সিম বের করে দিয়ে দিলেন। দেখলাম, তাঁদের কাছে ন্যানোসিমের ট্রে খোলার পিনও আছে। সিম-ট্রে ভেতরে ঢোকানোর সময় দেখলাম, মেমোরি কার্ড রয়ে গেছে। মেমোরি কার্ডটা চাইলে দিয়ে দিলেন। তারপর সেটটা বন্ধ করে দিলেন। আলো নেভার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, আমার মালিকানাও অন্ধকারে ডুবে গেল।
এদিকে ডান পাশের জন ব্যাগে কিছু না পেয়ে জিজ্ঞেস করছেন, ‘আপনার কাছে কত টাকা আছে।’ বললাম, ‘এখন তো এক টাকাও নেই, সব নিয়ে নিলেন।’
কিছু না পেয়ে ১০ মিনিটের ভয়ংকর চিরুনি তল্লাশি বন্ধ করলেন তাঁরা। বাঁ পাশের লোকটি বললেন, ‘আপনি সম্মানিত পেশায় আছেন, আপনাকে মলম লাগাব না। আমরা আপনাকে একটা রাস্তার মাথায় নামিয়ে দেব। আপনি কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ভেতরের দিকে পাঁচ মিনিট হাঁটবেন। এর ব্যতিক্রম হলে গুলি করে দেব।’ এর মধ্যে পেছন থেকে আসা লোকটি আবার পেছনের সিটে চলে গেলেন। তাঁরা ফাঁকা রাস্তার মাথা খুঁজছেন। এর মধ্যে লুদিয়ারা রাস্তার মাথা ফাঁকা পেয়ে গেলেন। নামানোর আগে বললাম, ‘সব টাকা তো নিয়ে নিলেন, আমাকে ভাড়ার টাকা দিন।’ পেছনের সিটে যাওয়া লোকটি ডান পাশে বসা লোকটিকে বললেন, ‘৫০০ টাকা দিয়ে দে।’
কিছুক্ষণ পর ৫০০ টাকা দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হলো। আমি নেমে আস্তে আস্তে হাঁটছি আর পেছনে আড়চোখে দেখছি। দেখি দরজা খোলা রেখে গাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। আরও একটু হাঁটার পর গাড়িটি গতি বাড়িয়ে দ্রুত চট্টগ্রামের দিকে চলে গেল। আমি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
জাহাঙ্গীর এইচ মজুমদার, নোয়াখালী।