অথই জলরাশিতে ভাসতে থাকলাম
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার হাওরাঞ্চলে আমার বেড়ে ওঠা। পানির সঙ্গে মিতালি করে শৈশবের দিনগুলো কেটেছে। দুরন্তপনা আর দস্যিপনা যা-ই করেছি, সব ওই বাড়ির পাশের নদীটা ঘিরে। চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে কত শত স্মৃতি। আহা, আমার সুখ! আমার ফেলে আসা দিন!
ঢাকায় আসি অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর। শহরের স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর তেমন একটা এলাকায় যাওয়া হতো না। আবার ব্যবসায়ী বাবা একসময় মায়ের চাকরির সুবাদে ঢাকায় স্থায়ীভাবে থিতু হয়ে গেলেন। নাগরিক ব্যস্ততায় ভুলে গেলেন হাওরপাড়ের সৌন্দর্যের ডাক। কিন্তু আমি ভুলিনি। সুযোগ পেলেই বছরে একবার, অর্থাৎ বর্ষাকালে চলে আসি দাদুর কাছে। মন-প্রাণ উজাড় করে উপভোগ করি হাওরের জলজ জীবনের স্বাদ।
সেদিন ছিল শনিবার। তিন দিন ধরে একনাগাড়ে পড়ছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। তার ওপর প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা। বাইরে বের হওয়া রীতিমতো চরম অসহ্যের ব্যাপার। ওদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে। কী করব বুঝতে না পেরে চাচাতো ভাই সুমনকে নিয়ে সেদিনের বিকেলবেলায় চলে এলাম নদীর ঘাটে। সুমনদের নৌকা আছে একটা। সেই নৌকায় চড়ে ভেসে বেড়ালাম নদীতে।
টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। সুমন নৌকা বাইছে। আমি দুচোখ ভরে দেখছি চারদিকের সৌন্দর্য। নদীর পানি আর বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে চমৎকার এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। তখনই ঘটল বিপত্তিটা।
সুমন নৌকা বাইতে বাইতে চলে গেল একদম হাওরের মাঝখানে। ছোট ছোট ঢেউয়ে দুলছে নৌকা। মৃদু বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে নাকে–মুখে। এমতাবস্থায়ও বেশ সাবলীলভাবে নৌকা বাইছে সুমন। দেখে আমারও ইচ্ছা হলো। সুমনের কাছ থেকে বইঠা নিয়ে আমিও বাইতে লাগলাম। এলোমেলোভাবে কিছুদূর যেতেই হাত থেকে পড়ে গেল বইঠা।
কঠিন স্বরে সুমন আমাকে ধমকাতে লাগল। আমি নির্বিকার। ঢেউয়ের তালে ভেসে চলেছে নৌকা, নিয়ন্ত্রণহীন। আশপাশে অন্য কোনো নৌকা, ট্রলার বা কার্গো চোখে পড়ছে না। হাওরে বেড়ে ওঠা দুজনের বুক ভয়ে জমে গেল। দুজনই সাঁতার জানি। তবে নৌকা থেকে নামা যাবে না। নেমে গেলে আরও বেশি বিপদ। অথই জলরাশিতে দুজনে ভাসতে থাকলাম।
মায়ের আদরে মুখটা ভেসে উঠল চোখে। নির্ভরতার প্রতীক বাবা যেন সামনে এসে দাঁড়ালেন। আর দাদু উদ্বিগ্ন হয়ে পথপানে চেয়ে আছেন, এখনো ফিরছে না কেন আমার দাদু ভাই! এত সব পূর্ণতার মধ্যেও অসহায় হয়ে গেলাম। হাওরের যত গভীরে যাচ্ছি, ঢেউয়ের তালে নৌকার দুলে ওঠা ক্রমশ বাড়ছে।
বৃষ্টির গতি বেড়ে যাওয়ায় অন্ধকারের মতো চারদিক একদম ধবধবে সাদা। আমি শেষ ভরসা হিসেবে চিৎকার করতে লাগলাম। গলা ফাটানো চিৎকার; বেঁচে থাকার করুণ আকুতি। বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ একটা স্পিডবোটের আওয়াজ শুনতে পেলাম আমরা। নদীর রেখা ধরে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। মরতে যাওয়ার ভয়ে নাকি বেঁচে যাওয়ার আনন্দে জানি না, সে সময় দুজন অনবরত অনেকটা সময় কাঁদলাম।
করিমগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ।