পাভেল। চিরকুট-এর ড্রামার ও সাউন্ড প্রডিউসার। বাটার রেকর্ডস নামের একটি স্টুডিও আছে তার। সে একাধারে সংগীত পরিচালক, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার এবং মিউজিক প্রডিউসার। নিয়মিত টিভি-রেডিও বিজ্ঞাপনের মিউজিক, জিঙ্গেল করছে। গান বাংলার জনপ্রিয় মিউজিক্যাল প্রজেক্ট ‘উইন্ড অব চেইঞ্জ’-এর চিফ সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছে শুরু থেকে। এত পরিচয় নিয়েও সব সময় আড়ালে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে দেখেছি পাভেলকে। এটাই বোধ হয় ওর স্বভাবের সুন্দরতম দিক।
২৭ বছর বয়সী আমাদের পাভেল আরিন ছোটবেলায় নাকি খুবই দুষ্টু ছিল। সুযোগ পেলেই শুধু ফাস্ট ফুডের দোকানে গিয়ে বসে থাকত (এখনো থাকে অবশ্য)। আন্টি (পাভেলের মা সেনোয়ারা আলী) জোর করে এখান থেকে ওখান থেকে ধরে নিয়ে এসে ওকে ড্রামস কিটের সামনে বসিয়ে রাখতেন। কারণ, আন্টি নাকি মনেপ্রাণে চাইতেন, পাভেল বড় হয়ে ড্রামার হোক। আঙ্কেলেরও (পাভেলের বাবা মো. সেকান্দার আলী) ফুল সাপোর্ট। আর তার সঙ্গে ওর মেজ ভাই টয় পৃথিবীর তাবৎ বিখ্যাত ড্রামারের বাজনা ওকে শোনাত আর উৎসাহ দিত। ওর বড় ভাই জিমি তখন অলরেডি ড্রামার। দেশের নামকরা ব্যান্ডের সঙ্গে বাজায়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে পাভেলের ড্রামার না হয়ে আর উপায় ছিল না। সেই থেকেই শুরু। শুনলে অবাক হবেন, পাভেল পেশাদারভাবে ড্রামস বাজানো শুরু করে যখন ও প্রথম শ্রেণিতে পড়ে এবং যখন ওর উচ্চতা ড্রামসের উচ্চতার চেয়ে কম ছিল। আর এসব মজার তথ্য পাভেলের আম্মা, আমাদের প্রিয় আন্টির কাছ থেকে পেয়েছি।
মা সেনোয়ারা আলীর স্বপ্ন ও পরিশ্রম সফল হয়েছে। পাভেল ড্রামারই হয়েছে। আজ সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত মুখ সে। পাভেল যখন ড্রামস বাজায়, ওর পুরো শরীর যেন কথা বলে। ওর ড্রামের তালে হাজার হাজার মানুষ কখনো মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে, কখনোবা বাঁধভাঙা উল্লাসে চিৎকার করে ওঠে। আর আমরা পারফরম্যান্স ভুলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। কখনো শৈল্পিক কখনো খ্যাপা আমাদের পাভেল। এ কারণেই আজ হাজার হাজার কিশোর-তরুণের আইকন সে।
সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এর মধ্যেই কনিষ্ঠতম সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পাভেল জিতেছে চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড। ডুব ছবিতে সংগীত পরিচালনার জন্য চলচ্চিত্র নিয়ে পৃথিবীর তিনটি সেরা পত্রিকা ভ্যারাইটি, হলিউড রিপোর্টার এবং স্ক্রিন ডেইলি পাভেলের সংগীত পরিচালনার ভূয়সী প্রশংসা করেছে। ভারতের ফিল্ম ফেয়ারে পাভেল পেয়েছে বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টরের মনোনয়ন। এগুলো নিয়ে আমরা উচ্ছ্বসিত হলেও কখনোই পাভেলকে বাড়তি উচ্ছ্বাসে ভুগতে দেখিনি। তবে সাউন্ড, গেজেট ও টেকনোলজি নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা, ঘাঁটাঘাঁটি করে এবং আমরা কেন এগুলো ঠিকমতো করি না, তা নিয়ে রীতিমতো মাথা খারাপ করে দেয় আমাদের।
আমাদের দেশের সাউন্ডকে এগিয়ে নিতে নিয়মিত নিত্যনতুন সংগীতযন্ত্র সংগ্রহ করে পাভেল। এ কারণে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা স্টুডিও বাটার রেকর্ডস তৈরি করেছে সে, যেটা খুবই ওয়েল ইকুইপড। আপ–টু–ডেট। উপমহাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি শ্রদ্ধেয় রুনা লায়লা সেদিন কাজ করতে এসে এই স্টুডিওর দারুণ প্রশংসা এবং দোয়া করে গেছেন। চিরকুটের সব প্রডাকশন এখানেই হয় বারো বছর ধরে।
আমাদের ব্যান্ডে পাভেল মানে পুরোটুকু ভরসার জায়গা। নিজের পজিটিভ শক্তি এবং বড় স্বপ্ন সবার মধ্যে সংক্রমিত করার দারুণ এক গুণ আছে পাভেলের। যদিও পাভেলের অভিব্যক্তিতে এর কিছুই বোঝা যায় না। ব্যান্ডের সদস্যদের যে কারও সমস্যার সমাধানে পাভেল এগিয়ে আসে সবার আগে। ওর ধৈর্য রীতিমতো অনুসরণ করার মতো। দর্শক–শ্রোতারা সাধারণত একটা ব্যান্ডের স্টেজ পারফরম্যান্স দেখে থাকেন। কিন্তু ব্যান্ডের পেছনে থাকে সংগ্রামের, টিকে থাকার আসল গল্পটা। যেটা একপ্রকার থ্যাঙ্কসলেস জব; কেউ দেখতে পায় না। ব্যান্ডের ফাউন্ডার মেম্বার হিসেবে বলতে পারি, যখন থেকে পাভেল ব্যান্ডে জয়েন করেছে, সেই গল্পে পাভেলকে পাশে পেয়েছি প্রতিটি সময়। যতটা স্যাক্রিফাইস ব্যান্ডের জন্য করা যায়, সেটা পাভেলকে করতে দেখেছি সব সময়, দিনের পর দিন।
মানুষ বেঁচে থাকে তার কাজের মধ্য দিয়ে। আমাদের পাভেল কঠোর পরিশ্রম আর কর্মগুণে ওর বয়সের চেয়ে এগিয়ে থেকেছে সব সময়। সামনে বিস্তর পথ বাকি। দোয়া করি সৃষ্টিকর্তা যেন ওকে সুস্থ রাখেন। কারণ, আমাদের এবং এই দেশের ওর মতো উৎসাহী তরুণদের কাছ থেকে পাওয়ার আছে অনেক অনেক কিছু।
শারমীন সুলতানা সুমি: চিরকুট ব্যান্ডের গায়ক, গীতিকার ও সুরকার