অসম্ভব মিষ্টি চেহারার একটি মেয়ে ততধিক মিষ্টি গলায় গান গাইছে। অত্যন্ত স্থিতধী, তাড়াহুড়ো নেই। গানের বক্তব্য আর মেজাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাথা নাড়ছে মৃদু; মুখজুড়ে ফুটে আছে একটা মাপা হাসি। গানের ফাঁকে ফাঁকে মেয়েটির হৃদয়গ্রাহী আবৃত্তি পরিবেশটাকে আরও শৈল্পিক করে তুলছে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি গান-কবিতার মেলবন্ধনের এই দারুণ শিল্পীর দিকে।
দারুণ এই শিল্পীর নাম আরমীন মূসা। কিছুদিন আগে সোনারগাঁও হোটেলে একটি অনুষ্ঠানে একসঙ্গে গান করেছিলাম আমরা। সেদিনই ওর গায়কি, পরিবেশনার ভিন্ন ভঙ্গিমা আলাদা করে আমার দৃষ্টি কেড়েছিল। আরমীন মূসা—নামটি মনে হলেই সেদিনের সেই চিত্রটি চোখে ভেসে ওঠে।
আরমীন যেন প্রতিভার সঙ্গে তারুণ্যের পরিমিত সমন্বয়। যে কথাটা লেখার শুরুর দিকেও বলেছি; অত্যন্ত স্থিতধী। খাপছাড়াভাবে নয় কিংবা বাড়াবাড়ি রকমেও নয়। আমার কাছে মনে হয়, ও সংগীত নিয়ে নিরীক্ষা করছে সংগীতটাকে জেনেবুঝেই। সেই জানাবোঝার মধ্যে যেমন আছে সংগীতের ওপর ওর উচ্চতর শিক্ষা, সেই সঙ্গে খাঁটি বাঙালিয়ানা মনন। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে ‘বার্কলি কলেজ অব মিউজিক’ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছে। নিশ্চয়ই সেখানেই পেশা গড়ে নিতে পারত। এ দেশে ফিরে না এলেও পারত। নিজেকে সমৃদ্ধ করে, দেশে ফিরে এসে দেশীয় অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করার নজির তো খুব বেশি নেই আমাদের। কিন্তু ও ফিরে এসেছে। ক্যারিয়ারের রঙিন হাতছানি, জৌলুশপূর্ণ জীবনের মোহ ছেড়ে বাংলার মেয়ে বাংলায় ফিরে এসেছে। ফিরে এসে কিন্তু তথাকথিত ‘তারকা’ হওয়ার পেছনে দৌড়ায়নি। সহজাত সংগীতপ্রতিভা এবং অর্জিত সংগীতজ্ঞান; দ্বৈত শক্তিকে পুঁজি করে বাংলা গান নিয়ে নিরীক্ষা করে যাচ্ছে। এই ব্যাপারটা আমার জন্য এবং আমাদের সংগীত অঙ্গনের জন্য আনন্দের।
আমি যত দূর জানি, আরমীন জ্যাজ, ব্লুজ, লোক, শাস্ত্রীয়, আধুনিকসহ প্রায় সব ধরনের গানই করে। এটি কিন্তু একটি বিশাল ব্যাপার। বাংলাদেশের একটি মেয়ে বাংলা সংগীতের সঙ্গে সমানতালে বিশ্বসংগীতের চর্চা করে যাচ্ছে, এটা গুরুত্বপূর্ণ বটে; কিন্তু এর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে আরেকটি যে দারুণ কাজ হচ্ছে, সেটা আরও বেশি গুরুত্ববহ। তা হলো, বাংলা সংগীতের সঙ্গে বিশ্বসংগীতের এক অপূর্ব সম্মিলন, একটি আদান-প্রদান। শিল্প-সংগীতকে তো গণ্ডিতে, কাঁটাতারে, ভৌগোলিক সীমারেখায় বাঁধা যায় না। খেয়াল করে দেখেছি, আরমীনের প্রতিটি কাজে সেই গণ্ডি পেরোনো শৈল্পিক প্রবণতার ছাপ।
‘ঘাসফড়িং’ নামে ওর যে গানের দলটি আছে, সেটি কিন্তু রীতিমতো গবেষণাধর্মী একটি প্ল্যাটফর্ম। দলটি শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নিচ্ছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়েই। সেখানে কোরাস ভয়েস (সম্মিলিত কণ্ঠ) নিয়ে আরমীনের যে নিরন্তর নিরীক্ষা, সেটি প্রশংসনীয়। অনেকগুলো কণ্ঠের সঙ্গে স্বতন্ত্র স্বর এবং সুরের সম্মিলনে একটি অভিন্ন আবহ তৈরি করতে পারা—এটা খুব সহজ কথা নয়। এ ধরনের কাজ খুব কম হয় আমাদের এখানে। আরমীন করছে। আরও প্রচুর হওয়া দরকার। ও কাজ করছে ‘কয়্যার’ নিয়ে, আকাপেলা ফর্ম নিয়ে। এ বছরই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেনের বিভিন্ন ভাষাভাষী ছাত্রীদের সম্মিলিত কণ্ঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো
একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির কয়্যার নির্দেশনা দিয়েছে আরমীন, যেটি আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছে।
গানের ফাঁকে ফাঁকে ওর যে আবৃত্তির কথা বলেছি গোড়ার দিকে, সেই ব্যাপারটি আরেকটু বলতে হচ্ছে। আমি যতটুকু দেখেছি, বাংলা গান কিংবা ইংরেজি গান; দুই ধরনের গানের ফাঁকেই কিন্তু ও দুই–চার পঙ্ক্তি আবৃত্তি করছে এবং তা ইংরেজিতে। ওর নিজেরই লেখা সেসব কবিতা। গানের বক্তব্যের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক সেসব কবিতা শ্রোতাকে গানের সঙ্গে আরও বেশি সম্পৃক্ত করে তোলে। গানের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতে সহজ হয় শ্রোতার জন্য।
কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের নাতনি নাশিদ কামালের মেয়ে আরমীন মূসা। নাশিদ কামাল অত্যন্ত গুণী শিল্পী। সংগীত পরম্পরার ব্যাপারটি আরমীনের ভেতর সংগীতের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করেছে নিশ্চয়ই। সংগীতটাকে পেয়েছে মজ্জাগতভাবেই। সংগীত পরিবারের সন্তান হিসেবে আমি নিজে তো বুঝতে পারি ব্যাপারটি। সুরের দ্যোতনা, বাদ্যের ঝংকার—এ রকম একটি সাংগীতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার ফলে ও কিন্তু মানসিকভাবে শিল্পী হয়ে গেছে সেই শিশুবেলাতেই। এখন আমরা যে আরমীন মূসাকে দেখতে পাচ্ছি, ওর কাজের যে বৈচিত্র্য দেখতে পাচ্ছি, তা কিন্তু নিঃসন্দেহে ওরই ব্যক্তিগত অর্জন। নিজস্ব মেধা, মনন, শিক্ষা আর বিরামহীন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ একটি স্বকীয় অবস্থান তৈরি করে চলেছে আরমীন।
অনুলিখিত
বাপ্পা মজুমদার: গায়ক ও সংগীত পরিচালক