উন্মাদ থেকে প্রতিবছরই আমরা কার্টুন প্রদর্শনীর আয়োজন করি। বেশ কয়েক বছর আগে সেবারও আমরা একটা কার্টুন প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। সবাই কার্টুন জমা দিচ্ছে। ডাকযোগে বা কুরিয়ারেও কার্টুন আসছে ঢাকার বাইরে থেকে। এ রকম এক ব্যস্ত সময়ে এক কিশোর এসে হাজির। তার হাতে এ-ফোর আকারের কিছু কাগজ।
কার্টুন এনেছ নাকি? আমি জিজ্ঞেস করি। সে মাথা নাড়ে।
হাতে নিয়ে দেখি উন্মাদ-এর জন্য আঁকা কিছু ফিচার-টাইপ কার্টুন। আমি সম্পাদকসুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে বললাম, ‘ওই যে ঘরের কোনায় ডাস্টবিনটা দেখছ, ওখানে এগুলো ফেলে দাও!’ কিশোর কার্টুনিস্ট হকচকিয়ে গেল। আমি তখন অভয় দিলাম। তুমি যা ভাবছ, তা নয়। ওই ডাস্টবিনে আমরা পরবর্তী সংখ্যার কার্টুন জমা রাখি। উন্মাদ অফিসে এটাই নিয়ম। সিলেক্টেড কার্টুন জমা থাকে ডাস্টবিনে (বিশেষ একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এই নিয়ম করেছিলাম তখন)। আমি তাকে বললাম, এই কার্টুনগুলোর কথা পরে ভাবা যাবে। তুমি বরং প্রদর্শনীর জন্য একটা কার্টুন আঁকো বড় করে। কারণ দু-এক দিনের মধ্যেই আমাদের কার্টুন প্রদর্শনী শুরু হবে। অবশ্য তাকে বললাম না যে তার কার্টুন প্রদর্শনীর জন্য সিলেক্ট না-ও হতে পারে। আগে দেখি না সে কী আঁকে। তাকে কার্টুনের বিষয় বললাম। সেবার ছিল পরিবেশ নিয়ে আমাদের কার্টুন প্রদর্শনী। সে ‘জি, ধন্যবাদ’ বলে বিদায় হলো।
আর কী আশ্চর্য বিকেলের মধ্যে সে রংচঙে একটি বিশাল কার্টুন নিয়ে হাজির! আইডিয়াটাও বেশ চমৎকার, পৃথিবীর ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছে কয়েকটা মুষ্টিবদ্ধ হাত—যাদের আদল গাছের মতো। বেশ ইন্টেলেকচুয়াল আইডিয়া। আমরা পছন্দ করলাম তার কার্টুন। উন্মাদ-এর বিশেষ পরিবেশবিষয়ক কার্টুন প্রদর্শনীতে স্থান পেয়ে গেল। এভাবেই মোরশেদ মিশুর কার্টুনে অভিষেক হলো সরাসরি গ্যালারিতে। তারপর থেকে অল্পবিস্তর করে তার কার্টুন উন্মাদ-এর পাতায় ছাপা হতে শুরু করল। আমি আবিষ্কার করলাম বয়সের তুলনায় সে বেশ ভালো আঁকে। আমাদের মূল প্রতিবেদনটা সাধারণত সিনিয়র কার্টুনিস্টরা আঁকেন। একবার তাকে দিলাম আঁকতে। দিব্যি আঁকল, তারপর কভার আঁকল। আমি ভাবলাম বাহ্ এই ছেলে আঁকাআঁকিতে এত দ্রুত উন্নতি করছে, এক দিয়েই হবে! তাকে আমরা অফিশিয়ালি সহকারী সম্পাদক হিসেবে গ্রহণ করলাম।
কিন্তু হঠাৎ করে সে গায়েব। আমি খোঁজ লাগালাম মিশু কোথায়? একজন জানাল সে ঢাকা শহরের সব দেয়াল ‘ধ্বংস’ করে দিচ্ছে। যাকে বলে ‘ওয়াল ডেস্ট্রয়ার’। মানে কী? পরে জানলাম সে ঢাকার বেশ কিছু নামীদামি রেস্টুরেন্ট, মিলনায়তন, অফিস, শ্রেণিকক্ষ—এসব জায়গার দেয়ালগুলোতে প্রফেশনালি ইলাস্ট্রেশন করছে। বিশাল সব কাজ। এমন না যে রংতুলি দিয়ে সে এই কাজ করছে। তার মাধ্যম হচ্ছে পেরেক, স্ক্রু, ফেলে দেওয়া লোহালক্কড়, বাতিল গাড়ির টায়ার...অদ্ভুত সব জিনিস। তবে অস্থির এই ছেলে খুব শিগগির আবার কার্টুনে ফিরে এল। তত দিনে তার কিশোরসুলভ চেহারা বদলে চে গুয়েভারা টাইপ একটা প্যাটার্ন নিয়েছে। তার ড্রয়িংয়ের প্যাটার্নও যেন বদলে গেল। সে আঁকতে শুরু করল ‘গ্লোবাল হ্যাপিনেস সিরিজ’। উন্মাদ–এর ৪০ বছরের প্রদর্শনীতে বিশাল বিশাল করে ছেপে আমরা প্রদর্শন করলাম। তারপর তো ইতিহাস। পৃথিবীর ২৬টি দেশে সেই কার্টুন ছড়িয়ে গেল। বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ফোর্বস-এর এশিয়ার ৩০ অনূর্ধ্ব ৩০ (থার্টি আন্ডার থার্টি) তালিকায় চলে এল মিশু, আমাদের ‘মোর্শেদ মিশু’। যার পুরো নাম আবদুল্লাহ আল মোরশেদ।
খেলাধুলা বা গানে হঠাৎ করে মানুষ রাতারাতি তারকা হয়ে যায়। এ রকম উদাহরণ আছে প্রচুর। কার্টুন এঁকেও যে রাতারাতি তারকাখ্যাতি পাওয়া যায়, সেটা প্রমাণ করল আমাদের মিশু। তাকে অভিনন্দন।
আহসান হাবীব: লেখক, কার্টুনিস্ট এবং মাসিক উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক