প্রিয় পাঠক, ক্ষমা করবেন। নিবন্ধের শুরুতেই কিছুটা ধান ভানতে শিবের গীত গাইব। না হলে নিজের কাছে অপরাধী হয়ে রইব।
ফেনীর সোনাগাজীর কন্যা যখন নির্যাতনের নানা বিপত্তি অতিক্রম করে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঢাকার বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে গিয়ে না–ফেরার দেশে পাড়ি জমাল, ঠিক তেমনি এক সময় এই লেখাটি লিখতে বসেছি। সমগ্র দেশবাসীর সঙ্গে জ্বলছি আমিও—দগ্ধ, অপরাধী ও দায় কাঁধে নিয়ে প্রায় সবাই কাতর। আমিও তাঁদের সঙ্গে দগ্ধ হচ্ছি অন্তরে। তবু বর্তমান সময়ের সংস্কৃতি তথা নাট্যাঙ্গনের তরুণ তারকা, যে তারকা মাটির তারকা, মঞ্চের তারকা—তৃণমূল মানুষের গল্প সুর বর্ণনা নিয়ে, হাওরের আলো-বাতাস গায়ে মেখে যিনি কিশোরগঞ্জের
মাটিতে কৈশোর কাটিয়ে এখন শিল্পে নিবেদিত এক প্রাণ, তিনি সায়িক সিদ্দিকী। তাঁকে সবাই পালাকার সায়িক নামেই চেনে।
বর্তমান সময়ের আধুনিক যুবক সায়িক সিদ্দিকীর শিল্পভাবনা অনেকটাই বিস্মিত করার মতো। মঞ্চে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখছি নাট্যরচনা, আঙ্গিক প্রয়োগ, কোরিওগ্রাফির প্রবল অত্যাচার, প্রযুক্তির অযথা ব্যবহার তথা উপস্থাপনার ঢঙে ক্রমেই জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নাটক যখন ক্রমেই হয়ে উঠছে সার্কাস, অ্যাক্রোবেটিক অথবা রচনায় যুক্তাক্ষর–সংবলিত বাক্যের প্রভাবে কবি মাইকেলকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা, তখন এই প্রজন্মের পালাকার মনে করেন, আমাদের মানুষ তথা দর্শক সরল ঢঙে গল্প বলাকেই বেশি পছন্দ করেন। সে দর্শক শহরের হোক অথবা গ্রামের—এটি আমাদের জাতিগত ঐতিহ্য। তাই সায়িক সিদ্দিকী সেই রীতিতেই পালা অভিনয় করেন এবং এ পথ ধরেই কাজ করে খুব অল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর ভাষায় আমি সমর্থন দিই—শিল্পের সরলতাই শিল্পের শ্রেষ্ঠত্ব।
সায়িক সিদ্দিকীকে আমরা আমাদের সায়িক বলে থাকি। আমাদের নাট্যাঙ্গনে নানা বয়সের কাজের ও অকাজের নেতাদের যে ভিড় জমেছে, তা থেকে সায়িক অনেক দূরে। অতি বিনয়ী, সদালাপী, কৌতূহলী সায়িক যেন সবার কাছে শিখতে চায়—আর সায়িককে আমার ভালো লাগার এটি একটি অন্যতম কারণ। আমরা যখন কিঞ্চিৎ শিখে বা না শিখেই শিক্ষক হয়ে যাই, সায়িক তখন কেবলই ছাত্র।
সায়িক ছোট-বড় নানা ধরনের কাজ করে যাচ্ছেন। শৈশবে কিশোরগঞ্জের প্রয়াত মুক্তি চৌধুরীর নৃত্যনাট্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। স্কুল ও কলেজজীবনে চারপাশের নানা ঘটনাকে কৌতুক করে বন্ধুদের মধ্যে পরিবেশন করতে করতে অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মায় তাঁর। এরই মধ্যে কুদ্দুস বয়াতি, ইসলামউদ্দিন পালাকারসহ নানা বয়াতির পরিবেশনা দেখার সুযোগ ঘটে। তাঁদের কাছে কোনো শিক্ষা নেননি সায়িক, তবে তাঁদের অভিনয়রীতি, আঙ্গিক, সুর প্রভাব ফেলেছে সায়িকের জীবনে। বলতে গেলে সায়িকের কোনো শিক্ষাগুরু নেই।
ধারণা করি, কিশোরগঞ্জের সন্তান বলে তার রক্তে, মগজে, মননে, দেহে পালাগানের মন্ত্রবীজ জন্মসূত্রেই আছে। তার পরিবেশনা নিয়মিতভাবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হওয়ার পাশাপাশি দেশের বাইরেও মঞ্চস্থ হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার একটি দলে নিজের লেখা কইন্যা শশীর পালার নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনা দিয়েছেন নদীয়া জেলার চাকদাতেও।
সায়িক একবার ভাবলেন মহাকবি শেক্সপিয়ার যদি বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করতেন এবং রোমিও–জুলিয়েট নাটকটি লিখতেন, তাহলে তাঁর রচনাশৈলী ও উপস্থাপনাটা কেমন হতো! তাই নিয়েই শুরু হয়ে গেল সায়িকের কাজ এবং তৈরি হলো নিজেরই রূপান্তরিত পালা ভানু সুন্দরীর পালা।
সায়িক সিদ্দিকীর উল্লেখযোগ্য পালাগুলোর মধ্যে আছে রূপচান সুন্দরীর পালা, ভানু সুন্দরীর পালা, নোলক জানের পালা, গুনজান বিবির পালা, কইন্যা শশীর পালা, জয়তুন বিবির পালা ইত্যাদি। ২০১৭ সালে স্পেনে আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের বিশ্ব কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা সায়িকের রূপচান সুন্দরীর পালার অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। কংগ্রেস কমিটির নির্দেশ ছিল ১০ মিনিটের মধ্যে অভিনয় শেষ করার। সে নিয়মে রূপচান সুন্দরীর পালা ১০ মিনিট অভিনীত হয়। পরবর্তী সময়ে উৎসব চলার সময় কর্তৃপক্ষ সায়িক সিদ্দিকীকে ডেকে পালা ৪০ মিনিট ব্যাপ্তিকালের মধ্যে অভিনয়ের সুযোগ করে দেয়। কারণ একটিই—পালাটি তাদের ভালো লেগেছিল, যেটি শিল্পের প্রথম শর্ত।
অনেকেই মনে করেন, মঞ্চনাটকের সবকিছু ঠিক রেখে শুধু সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে পথে অভিনয় করলেই তা পথনাটক হয়ে যায়। আমরা অনেকেই ভুলে যাই যে পথনাটক একটি সার্বভৌম শিল্প। তাঁর রচনাশৈলী, অভিনয়রীতি, অভিনয় স্থান—সবটাই ভিন্ন। এই ভাবনা থেকে বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ একটি আবাসিক কর্মশালার আয়োজন করে। নবীন নাট্যকারদের পথনাটক রচনার মধ্যে আমরা পালা নির্মাণের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করি। সেখানে সায়িক সিদ্দিকী প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। আমরা চাই পথনাটকের মধ্যে পালাগানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হোক। সায়িকের প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়েই পথনাটক উৎসব ২০১৯–এ একটি সফল পালা প্রযোজনা পরিবেশিত হয়।
সায়িক সিদ্দিকীর কাজের অভিনবত্ব হচ্ছে যেকোনো ঘটনা, ইস্যু, গল্প, লোককাহিনিকে তিনি আধুনিক সময় ও সমাজের সঙ্গে যুক্ত করে পরিবেশন করেন। এখানেই তাঁর মুনশিয়ানা। আমরা এটিও লক্ষ করেছি যে সমকালীন করে তুলতে গিয়ে সে সজাগ থাকে, যেন তা আরোপিত না হয়ে ওঠে।
এবার লেখাটি শেষ করার পালা। আমরা জানি যে আমাদের প্রাচীন লোকনাট্য পালাগানে অধিকাংশ গল্পের প্রধান চরিত্র নারী। তার প্রেম, দুঃখ, ভালোবাসা, সংগ্রাম ইত্যাদি নানা সুর, কথা, বর্ণনা, নৃত্য, বাদ্য ও কৌতুকময় সংলাপের মধ্য দিয়ে বর্ণিত হয়। তাই সায়িকের পালাগান নিয়ে লিখতে বসে বর্তমান সময়ের নানা নারীর মুখ ভেসে উঠল সামনে। দিনাজপুরের ইয়াসমীন, সিরাজগঞ্জের পূর্ণিমা, পার্বত্য কন্যা কল্পনা চাকমা, কুমিল্লার তনু, ফেনীর নুসরাত—এরাই কি এখন হয়ে উঠবে পালাগানের নায়িকা! মহুয়া, গুনাইবিবি, রূপবান, মালকা বানুর জায়গা দখল করবে ওরা! ওদের জীবনের আত্মাহুতির কাহিনি কি বর্ণিত হবে আজকের দিনের পালায়?
আজ আমার লেখায় যে কালো কালি, তা আমি দেখি লাল—বুঝে ফেলি এ হলো নুসরাতের রক্ত! তাই সায়িক সিদ্দিকীর কাছে বিনীত অনুরোধ, এই তপ্ত বৈশাখের রোদে মানুষের শিল্প নিয়ে কাজ করা আপনি প্রতিজ্ঞা করুন, নুসরাত হোক আপনার আগামী পালার মহানায়ক। মৃত্যুর পূর্বে নুসরাত ঘোষণা করেছিলেন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমৃত্যু প্রতিবাদের। তার এই প্রতিবাদের ভাষা ও দর্শন দিয়ে মৃত্যুশীতল মস্তিষ্ক নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা অবশ মানুষগুলোকে আপনি জাগ্রত করুন।
অভিনন্দন সায়িক সিদ্দিকী। জয় হোক পালাগানের।
মান্নান হীরা: নাট্যকার