ক্যামেরায় আগুনের মৃত্যুফাঁদ
>শুরুটা ১৯৯৮ সালে। এরপর ভয়াবহ সব অগ্নিকাণ্ডের ছবি তুলেছেন আলোকচিত্রী আবীর আবদুল্লাহ। আগুনের ভয়াবহ ছোবলে প্রাণহীন দেহের ছবি তুলতে গিয়ে মর্মাহত হয়েছেন, ক্যামেরার বোতামে আঙুল থমকে গেছে। তবু তুলেছেন ছবি। সেসব মর্মস্পর্শী ছবির শিরোনাম ‘মৃত্যুফাঁদ’। ২০১২ সালে সেই সিরিজ ছাপা হয়েছে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায়। সর্বশেষ চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ছবিসহ ‘মৃত্যুফাঁদ’ সিরিজের অভিজ্ঞতা লিখেছেন আবীর আবদুল্লাহ।
ছোটবেলার একটা ছবি খুব চোখে ভাসে। আমাদের বাসা থেকে সিকি মাইল দূরে তেলের ডিপোতে আগুন লেগেছে। তেলের ড্রামের ঢাকনি প্রচণ্ড গতিতে এদিক–ওদিক উড়ে উড়ে গিয়ে পড়ছে। বিশাল আগুনের লেলিহান শিখা মনে হচ্ছে আমাদের দিকে ধেয়ে আসবে। আমার আব্বা বাসার রেলিংহীন ছাদে দাঁড়িয়ে দূর থেকে আগুনের দিক বরাবর শূন্যে বালু ছুড়ে মারছেন। কেঁদে কেঁদে আল্লাহকে ডাকছেন আর বলছেন সবাইকে বিপদ থেকে রক্ষা করো। সে যাত্রায় আগুন আমাদের বাসা পর্যন্ত আসেনি, অনেক চেষ্টার পর আগুন নেভান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে প্রথম আগুন লাগার ছবি তুলি ঢাকার আগারগাঁওয়ের বিএনপি বস্তিতে ১৯৯৮ সালে। সেই আগুনে পুড়ে মারা যায় ছোট্ট একটি শিশু। আমি সেই শিশুর ছবি তোলার পর খুবই মর্মাহত হয়ে পড়ি। সেই শিশুর সারা শরীর পুড়ে মাথাটা বেলের মতো হয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে আমি লক্ষ করলাম, আগুন লাগার বিষয়টা কিছুদিন পরপর ঘটছে। বেশির ভাগ সময় আগুন লাগছে মানুষের অসাবধানতার কারণে। গ্যাসের চুলা, মশার কয়েল, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ইত্যাদি থেকে আগুন লাগছে। ঠিক করলাম, আগুন লাগার ছবি তোলার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে। সেই চিন্তা মাথায় নিয়ে ‘মৃত্যুফাঁদ’ শিরোনামে ছবি তোলা শুরু করলাম।
২০১০ সালে রাজধানীর নিমতলীর আগুনের ঘটনায় রাত ১২টার সময় ডেইলি স্টার পত্রিকার ফটোসাংবাদিক পলাশ আমাকে ফোন করে জানায় যে রাস্তায় শুধু লাশ আর লাশ। স্পটে গিয়ে দেখি, চারদিকে অন্ধকার। মানুষ মোবাইল ফোনের আলোয় স্বজনের চেহারা চেনার চেষ্টা করছে আর আহাজারি করছে। শরীরগুলো এতটাই পুড়ে গেছে যে কাউকে চেনার উপায় নেই। আমি থমকে দাঁড়িয়ে থাকি, আমার আঙুল ক্যামেরার শাটার বাটনে আটকে থাকে, ছবি তুলতে ভুলে যাই। স্বজনহারা মানুষের বেদনা আমাকে আলোড়িত করে, শোকার্ত করে তোলে। আগুনে আহত মানুষের কষ্ট দেখে অস্থির হয়ে পড়ি। আমার বড় ছেলে নীলাভ্রর ছোটবেলায় গরম পানিতে পিঠ থেকে কোমর পর্যন্ত পুড়ে যায়। ছেলের সেই কষ্ট দেখে যতটা মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করেছিলাম, ঠিক ততটাই যন্ত্রণায় কাতরাই আগুনে আহত মানুষ দেখে।
২০১১ সালে আমস্টারডাম ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাই। আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছিল নিরিবিলি এক অভিজাত এলাকায়। একদিন মাঝরাতে আগুনের সতর্কসংকেত (ফায়ার অ্যালার্ম) বাজার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়, ঘরের লাউড স্পিকারে বলা হতে থাকে দ্রুত রুম থেকে বের হতে। লিফট ব্যবহার না করে, সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যেতে। আমি কোনো রকমে ঘর থেকে বের হয়ে দ্রুত নিচে নেমে যেতে যেতে ভাবি, নিজের দেশে সাহসের সঙ্গে এত আগুনের ছবি তুলেছি, আর এখন কিনা বিদেশের মাটিতে আগুনে পুড়ে মারা যাব!
প্রচণ্ড ভয় নিয়ে নেমে দেখি, ৫–৬ জন আমার আগেই চলে এসেছেন। অল্প কিছুক্ষণ যেতেই টের পাই, বাইরে হিমাঙ্কের নিচে ৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা। আমি ঠান্ডায় জমে যাওয়ার উপক্রম। ফায়ার অ্যালার্ম আর ঘটনার আকস্মিকতায় আমি শুধু রাতে শোবার কাপড় পরে নিচে নেমেছি। যা–ই হোক, এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর জানা গেল, ফায়ার অ্যালার্মটা ফলস ছিল। সকালবেলা ঘরের দরজায় দেখি একটা চিঠি, তাতে গত রাতের ঘটনায় সবাইকে নিচে নিয়ে বিরক্ত করার জন্য হোটেল কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চেয়েছে।
২০১২ সালে আশুলিয়ায় পোশাক কারখানা তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের পরদিন ছবি তুলতে তুলতে দেখি, একজন নারী শ্রমিকের আগুনে পোড়া মুখ। কপালে লাল টিপটা পুড়ে কালো হয়ে আছে, অথবা কপালের ঠিক মাঝখানে, যেখানে টিপ পরে, সেখানে আগুনে পোড়া একটা দাগ ঠিক টিপের মতো। নাক ফুলে ঈষৎ আলো পড়ায় চিকচিক করছে। আমি আবারও থমকে যাই, আমার আঙুল শাটার বাটনে থেমে থাকে। ছবি তুলতে ইচ্ছে করে না।
তবু ছবি তুলতে হয়! গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার চকবাজারে আগুনে পুড়ে মারা গেল অনেক প্রাণ। কার দায়, কে করবে প্রতিকার? আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরগুলোতে পড়ে আছে শেষ স্মৃতিগুলো। দেয়ালে ঝুলে আছে পুড়ে যাওয়া ছবি, টেবিলে পড়ে আছে খাবারের থালা, ভাত–তরকারি। অ্যাকুয়ারিয়ামে বেঁচে যাওয়া একটা মাছ একবার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত করছে, সেটাও টের পেয়ে গেছে, তার মনিবেরা কেউ আর তাকে খাবার খেতে দেবে না।
১৯৯৮ থেকে ২০১৯—এই দীর্ঘ সময়ে বস্তির আগুন, বাসাবাড়িতে আগুন, কারখানার আগুন, প্লাস্টিক কারখানার আগুন, বয়লার বিস্ফোরণের আগুন ও শপিং মলের আগুনের ছবি তুলতে গিয়ে আমার বারবার মনে হয়েছে, আমরা আমাদের লোভ, অসততা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর উদাসীনতায় নিজেরাই নিজেদের মৃত্যুফাঁদ তৈরি করেছি। তার খেসারত দিতে হচ্ছে অনেক ক্ষয়ক্ষতি আর প্রাণহানিতে।