ক্লাস ফোরে পড়ি। জানি না অত কম বয়সের ঘটনা এখনো কেন তাড়িয়ে বেড়ায়।
২০০৬ সালের জুন মাস। চট্টগ্রামে মামার বাড়ি গিয়েছিলাম। ঈদ ও রোজার বন্ধ কাটিয়ে বাড়ি ফিরছি। মা-বাবার সঙ্গে আমরা তিন ভাইবোন।
যানজটের কারণে পতেঙ্গা থেকে দুপুরে রওনা দিয়েও বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালে পৌঁছাতেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। তার ওপর আবার মুষলধারে বৃষ্টি। আমাদের ধরতে হবে কক্সবাজারগামী বাস। বাবা আমাদের একটা জায়গায় বসিয়ে রেখে কাউন্টারে গেলেন গাড়ির খোঁজে। একটু পর ফিরে এসে জানালেন, সরাসরি বাস আছে, তবে সেটা রাত আটটায়।
তখনো একটানা বৃষ্টি হচ্ছিল। রাত আটটার গাড়ি ধরলে পৌঁছাতে বড্ড দেরি হয়ে যাবে। তাই মা বললেন লোকাল বাসে উঠে পড়তে। টার্মিনালে গাড়িগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে। রাস্তায় দু-একটা গাড়ি চলছে, তবে মানুষের যাতায়াত নেই বললেই চলে। ঘড়ির কাঁটায় তখন কয়টা মনে নেই। রাত বেড়ে যাওয়ায় মায়ের মনে দুশ্চিন্তা ভর করেছে। একটা কক্সবাজারগামী বাস এগিয়ে আসছে দেখে বাবা হাত উঁচিয়ে ডাক দিলেন। দাঁড়াল সেটা। আমাদের তুলে নিল।
গাড়িতে উঠে দেখি চালক আর তাঁর সহকারী ছাড়া আর কেউ নেই। নতুন ব্রিজ এলাকায় আসার পর দুজন যাত্রী উঠলেন। তাঁরা দুজনে গিয়ে পাশাপাশি বসলেন আমাদের একই সারিতে। পরে আরও দুজন উঠে বসলেন আমাদের পেছনের আসনে। এভাবে একসময় বাসটি পূর্ণ হয়ে গেল। ভেতরের আলো নিভিয়ে বাস চলতে লাগল তার নিজস্ব গতিতে। বাইরে বৃষ্টি হওয়ায় মৃদু ঠান্ডায় যাত্রীরা যে যার মতো ঘুমিয়ে। আমরাও এর ব্যতিক্রম নয়।
ঘণ্টা দেড়েক যাওয়ার পর আচমকা হইচইয়ের শব্দ শুনে সবার ঘুম ভেঙে গেল। জেগে দেখি গাড়ি জনমানবশূন্য একটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, গাড়ি এখন কোথায়? বাবা বললেন, দোহাজারী। আশপাশে তাকিয়ে দেখি সবার মুখে উদ্বেগের ছাপ। আরও দেখতে পেলাম পাশের সারিতে যে দুজন মানুষ আমাদের পরপর উঠেছিল, তাদের আসন ঘিরে একটা জটলা। একটু উঁকি দিয়ে দেখলাম ওখানের একটি আসন ফাঁকা, আরেকটি আসনে একজন মানুষ অজ্ঞান অবস্থায় মুমূর্ষু হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর আসনের নিচে ফাঁকা মানিব্যাগ, কিছু কাগজপত্র এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। সবাই অনেক ডাকাডাকি করা সত্ত্বেও লোকটি উঠছেন না। তাই চালকের সহকারী পানির বোতল থেকে পানি বের করে ছিটালেন। তবু লোকটি উঠলেন না। এতক্ষণে সবাই যা বোঝার বুঝে ফেলেছেন। তিনি আসলে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়েছেন।
বাবা একসময় আবিষ্কার করলেন, আমাদের পেছনে বসা যাত্রীরাও নেই। এবার সবাই চালকের সহকারীকে কবজা করলেন। একজন তো বলেই উঠলেন, ‘অ্যাই মিয়া, তোমার চোখের সামনে তিন-তিনজন মানুষ নেমে গেল, তুমি একবারও বুঝলা না ওরা আসলে হাইজ্যাকার।’ সে বলতে চাইল, সাধারণ যাত্রী ভেবে নামতে দিয়েছে।
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইরে তখনো বৃষ্টি হচ্ছে। সবাই অজ্ঞান সেই ব্যক্তিকে নিয়ে মহাবিপদে পড়ে গেলেন। খোঁজাখুঁজির পর তাঁর মানিব্যাগ থেকে একটি মোবাইল ফোনের নম্বর লেখা কার্ড পাওয়া গেল। একজন ওই নম্বরে কল দিলেন। ভাগ্য ভালো, নম্বরটা তাঁর পরিবারের। তাঁর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ হলো। বাড়ি থেকে অনুরোধ করা হলো তাঁকে ওই অবস্থায় মালুমঘাট খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে নামিয়ে দিতে। তাঁরা ওখানে থাকবেন।
বাবার কাছে জানলাম, সেই মানুষ একজন মাছ ব্যবসায়ী। চট্টগ্রামে মাছ বিক্রি করে দোলহাজারায় ফিরছিলেন। হয়তো মাছ বিক্রির টাকা দেখে অজ্ঞান পার্টির লোকজন তাঁকে তখন থেকেই টার্গেট করছিল। বাবা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন ওই মাছ ব্যবসায়ীর পাশে বসা লোকটি তাঁকে পান খেতে দিচ্ছে। বাবা মনে করেছিলেন, দুজন হয়তো পূর্বপরিচিত। বাবার কথা শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম। কারণ, পেছনের সিটে বসা অজ্ঞান পার্টির একজন আমাকেও একটা চকলেট খেতে দিয়েছিল। ভ্যাগিস আমি ওটা কী মনে করে যেন পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম।
সেদিনের ঘটনা মনে পড়লে এখনো আমাদের সবার গা শিউরে ওঠে। রাত সাড়ে ১০টায় যখন চকরিয়া এসে নামি, তখনো সেই মানুষের জ্ঞান ফেরেনি। নামার সময় মানুষটিকে অজ্ঞান অবস্থায় নিথর হয়ে পড়ে থাকতে দেখে সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।