১৮৮৭ সালের ৩ মার্চ। কর্নেল আর্থার কেলারের বাসায় এলেন অ্যানি সুলিভান নামের ২০ বছর বয়সী এক তরুণী। সামরিক কর্মকর্তার প্রাণহীন বাসাটা যেন অনেকটা প্রাণ ফিরে পেল। অনাগত দিনগুলো নিরানন্দ আর আশঙ্কার চাদরে মুড়ে যেভাবে যাত্রা শুরু করেছিল ভবিষ্যতের দিকে, তাতে আর্থার-কেট দম্পতি ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলেন। তাঁদের ৬ বছর বয়সী কন্যা হেলেন কেলার, মাত্র ১৯ মাস বয়সেই দৃষ্টি, বাক্ ও শ্রবণশক্তি হারায়। তারপর থেকে কেলার দম্পতি পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশেষজ্ঞদের দুয়ারে। একদিন নিয়ে গেলেন অ্যালেক্সান্ডার গ্রাহাম বেলের কাছে।
যোগাযোগপ্রযুক্তির পুরোধা ব্যক্তিত্ব, টেলিফোন আবিষ্কারক বেল পরামর্শ দিলেন, হেলেনকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পারকিনস ইনস্টিটিউটে ভর্তি করিয়ে দিতে। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার হো নিজে হেলেনের শিক্ষার ভার নেন। কিন্তু কিছুদিন পর অকস্মাৎ মারা যান তিনি। এরপর নতুন পরিচালক মাইকেল অ্যাগানেস হেলেনের শিক্ষার দায়িত্বভার তুলে দেন অ্যানি সুলিভানের কাঁধে।
অ্যানি সুলিভান নিজেও প্রাথমিক জীবনের দীর্ঘ একটি সময় দৃষ্টিস্বল্পতায় ভুগেছেন। ফলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার অসহায়ত্ব এই নারীর মতো করে অন্য কেউ বুঝতে পারার কথা নয়। পারকিনস ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক সুলিভান যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাবামার তাসকাম্বিয়া গ্রামে হেলেনের বাড়িতে যেদিন গৃহশিক্ষক হিসেবে যান, কেলার দম্পতি কি বুঝতে পেরেছিলেন, কতটা আলোকিত ভবিষ্যতের প্রদীপ হাতে উপস্থিত হয়েছেন এই নারী?
স্পর্শের মাধ্যমে জ্ঞান বিনিময়ের অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী সুলিভান শিশু হেলেনের হাত ছুঁয়েই বুঝতে পেরেছিলেন, দারুণ প্রতিভাধর এই শিশু। সেই সঙ্গে ভীষণ একগুঁয়ে এবং রাগীও বটে। কিন্তু সুলিভানের স্পর্শ রীতিমতো জাদুকাঠির পরশের মতো প্রভাব ফেলল হেলেনের জীবনে। জেদি মেয়েটা কেমন বাধ্য হয়ে যেতে শুরু করল। স্পর্শের মাধ্যমে বানান করে করে পড়তে শেখাতে শুরু করলেন অ্যানি। প্রথম যেদিন কল চালিয়ে হাতের ওপর গড়িয়ে পড়া পানিকে শেখালেন ‘ওয়াটার’ বলে—অবাক হলো হেলেন।
সেই যে শিশু হেলেনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন অ্যানি সুলিভান, ছায়ার মতো পাশেই থেকেছেন সব সময়। ২০ বছর বয়সে হেলেন ভর্তি হন র্যাডক্লিফ কলেজে। সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে চার বছর পর বিএ পাস করেন। এরপর তিনি যখন তাঁর প্রথম বই দ্য স্টোরি অব মাই লাইফ লেখেন—দারুণভাবে সমাদৃত হন পাঠকমহলে। বইটির পরতে পরতে পরম যত্নে ছড়িয়ে আছে তাঁর জীবনে অ্যানি সুলিভানের স্নেহময় প্রভাবের কথা। এরপর নিয়মিত লেখালেখি এবং বিভিন্ন সমাবেশে বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন গেড়ে নেন হেলেন। সারা জীবন দুঃখী, অসহায়, প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন তিনি। তাঁর পাশে সার্বক্ষণিক ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকেছেন সুলিভান।
১৮৬৬ সালে ম্যাসাচুসেটসে জন্ম নেওয়া সুলিভান ১৯৩৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। প্রতিবন্ধী মানুষের আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হেলেন কেলার মারা যান ১৯৬৮ সালের ১ জুন।
হিস্ট্রি ডট কম অবলম্বনে