আবাসিক হোটেলটির দোতলায় ছিমছাম বসার ঘর। সেখানেই কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। তবে যতটুকু বসেছিলাম, তাকে অপেক্ষা বলা যায় না। খবর পেয়েই চলে এলেন ক্যারোলিন। মিষ্টি হাসিতে স্বাগত জানালেন। ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গেস্টহাউস খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’
৩০ জানুয়ারির পড়ন্ত বিকেলে ঢাকার গুলশান এলাকার হোটেলটি খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি জেনে তাঁর চোখেমুখে একধরনের স্বস্তি ভর করল। ক্যারোলিন বাংলাদেশে আগেও এসেছেন। প্রথম এসেছিলেন ২০০৮ সালে। একটি ড্যানিশ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মী হিসেবে পা রেখেছিলেন তিনি। বললেন, ‘বাংলাদেশে অল্প দিন কাজ করেই আমার ভালো লেগে যায়। তবে আমি তখনো জানতাম না এ দেশে আবার আসব। আসব আমার শিকড়
সন্ধানে।’ দু-এক কথায় আমরা ডুব দিলাম ক্যারোলিন লরিটজেন নামের এই ড্যানিশ নারীর শিকড় সন্ধানী পর্বে।
ডায়েরির পাতায় স্মৃতির হাতছানি
ক্যারোলিন জানতেন, তিনি বাবা–মায়ের দত্তক সন্তান। কিন্তু সে জানাটা ছিল অস্পষ্ট। তাই একটা সময় ভেবেছিলেন বাংলাদেশে পরিবারের কেউ হয়তো বেঁচে নেই। এ বিষয়ে খোঁজার চেষ্টাও করেননি। কিন্তু গত বছরের একটি ঘটনা তাঁকে উৎসাহী করে তুলল শিকড় সন্ধানে। তাঁর প্রয়াত ড্যানিশ মায়ের লেখা একটি ডায়েরি হাতে নিয়েছিলেন। ডায়েরির পাতা ওলটাচ্ছিলেন একমনে, সেখানেই কোনো একটি পাতায় তাঁর দত্তক নেওয়ার তথ্য ছিল। সে লেখাতেই জানতে পারেন, ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ময়মনসিংহের একটি হাসপাতালে তাঁকে পাওয়া যায়। কেউ নিতে না আসায় তাঁকে টেরে দেস হোমসে পাঠানো হয়। এই হোমের একজন নার্সের তত্ত্বাবধানে সাত মাস থাকার পর নভেম্বরে তাঁকে ড্যানিশ দম্পতি টোভ ও লিফ লরিটজেন দত্তক নিয়ে ডেনমার্কে চলে যান। এসব কথার সঙ্গে ছিল একটি চিঠি। ক্যারোলিন বলছিলেন, ‘চিঠিটি ছিল ড্যানিশ এক নার্সের। যিনি আমার দত্তক নেওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করেছিলেন। হোমের পক্ষ থেকে দত্তক মা-বাবার কাছে আমি কেমন আছি, তা তিনি নিয়ম মেনে খোঁজ নিতেন।’
ক্যারোলিন নেমে পড়লেন সেই নার্সের খোঁজে। কিন্তু এত দিন পর তাঁকে খুঁজে পাওয়ার কাজটি কঠিন মনে হলো। তিনি তখন খোঁজ করলেন তাঁকে দত্তক নেওয়ার সময় কোন কোন নার্স ঢাকায় কাজ করেছেন। এ জন্য তিনি বৈঠক ডাকলেন ডেনমার্কের টেরে দেস হোমসে। তিনি জানতে পেরেছিলেন তাঁর মতো আরও কয়েকজন শিশু সে সময় দত্তক সন্তান হিসেবে ডেনমার্কে বিভিন্ন পরিবারে জায়গা পায়। তখন নিজের ফেসবুকে দত্তক হিসেবে আর ডেনমার্কে এসেছেন কি না, তা জানাতে আহ্বান জানান। একসময় পেয়েও গেলেন এক নারীকে। দুজনে নিজেদের দুঃখগাথা ভাগাভাগি করলেন।
আশাবাদী ক্যারোলিন
সেই সাক্ষাৎই আজ ক্যারোলিনকে বাংলাদেশে এনেছে। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কিছুদিন পরই ডেনমার্কভিত্তিক অ্যানসেস্ট্রি, মাই ফ্যামিলি ট্রি ও মাই হেরিটেজ ডট কম নামে তিনটি ডিএনএ শনাক্তকারী প্রতিষ্ঠানে নিজের ডিএনএর মিল খোঁজার চেষ্টা করেন। ক্যারোলিনের ডিএনএ কোডের সঙ্গে মিল রয়েছে এমন একজনকে খুঁজে পান। তৃতীয় প্রজন্ম ডিএনএর সঙ্গে মিল পাওয়া অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি এই নারীর নাম আখতার জাহান। ক্যারোলিন তাঁকে ই-মেইল করেন। জবাব দিলে জানতে পারেন, তাঁর বাড়িও বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। দুজনের কথা হয় আরও কয়েক দফা। আশাবাদী হলেন ক্যারোলিন। তখনই আখতার জাহান ক্যারোলিনকে জানান, তিনি ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে দুই সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে যাচ্ছেন। ক্যারোলিন বলছিলেন, ‘আমাকে তিনি বাংলাদেশে আসার জন্য নিমন্ত্রণ করেন। আমিও সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি। বাংলাদেশে এসে আমি তাঁর বাসাতেই প্রথমে উঠেছিলাম।’
আমাদের আলাপের মধ্যেই তাঁর দুজন অতিথি এলেন। তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন ক্যারোলিন। একজন গণপূর্ত অধিদপ্তরের সহকারী মুখ্য প্রকৌশলী আইনুল ফরহাদ এবং তাঁর স্ত্রী ঢাকার বদরুন্নেসা কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সোনিয়া রহমান। ক্যারোলিন জানালেন, ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে এসে আখতার জাহানের বাসায় ওঠার পর এক রেস্তোরাঁয় আখতার জাহানের দুই ভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হন তিনি; এঁদেরই একজন আইনুল ফরহাদ।
আইনুল ফরহাদ বললেন, ‘আমি ডিএনএ টেস্ট করাইনি। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই ক্যারোলিনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। ক্যারোলিন ময়মনসিংহের মেয়ে। তাঁর নাম ছিল আমেনা। এই তথ্য কিন্তু তাঁর দত্তক গ্রহণসংক্রান্ত কাগজে আছে। সে সময় তাঁর পাসপোর্টের ছবি, টেরে দেস হোমসের সামনে তাঁর ছবি সব প্রমাণ আছে।’
ক্যারোলিন লরিটজেন আইন বিষয়ে স্নাতক। বর্তমানে ডেনমার্কের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে খণ্ডকালীন চাকরি করছেন। কাজ করেন মানবাধিকার নিয়েও। সেদিন বিদায়বেলায় তাঁর কণ্ঠে ভর করেছিল আশা-নিরাশা। তাঁর আকুতি আর অস্থিরতা উপস্থিত সবার মনকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। তিনি মনে করেন, ডিএনএ মিল পাওয়া এই পরিবারের হাত ধরেই তিনি হয়তো শিকড়ের সন্ধান পাবেন। জানবেন কে তাঁর বাবা, কে তাঁর মা।
এরই মধ্যে ডেনমার্ক ফিরে গেছেন ক্যারোলিন। তবে ঘুরে গেছেন জন্ম শহর ময়মনসিংহ।