ইতালির ত্রেন্তো শহরকে বলা যায় নদী আর পাহাড়ের সখা। আদিজে নামের শান্ত নদী আর ছোট ছোট পাহাড় যেন শহরটাকে আগলে রেখেছে। এই শহরের ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন আসাফ উদ দৌল্লা। ঢাকা থেকে সেদিনই গিয়েছেন তিনি। চলতে চলতেই তরুণ আসাফ থমকে দাঁড়ালেন। সড়কের পাশের বিলবোর্ডে ছবি দেখে তাঁর চোখজোড়া যেন ছানাবড়া। এক হাতে পদ্মফুল, অন্য হাতে পদ্মপাতায় বৃষ্টি ঠেকানোর চেষ্টারত বালকের ছবিটি তাঁর শরীরে যেন আনন্দের ঢেউ তুলল। আনন্দে আনমনেই তাঁর চোখ বন্ধ হলো। বন্ধ চোখে ত্রেন্তো শহরটা তাঁর কাছে হয়ে উঠল বাংলাদেশের জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের এক নিভৃত গ্রাম। আসাফের ক্যামেরাতেই যে এই ছবির জন্ম।
১৫ অক্টোবর ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে আসাফ উদ দৌল্লা আবারও ফিরে গেলেন সেই ছবির গল্পেই, ‘ছবিটা গত বছর তুলেছিলাম। ছুটিতে আক্কেলপুরে বাড়িতে যাই। আমাদের শান্তা গ্রামের পাশেই একটি পদ্মপুকুর আছে। ক্যামেরা কাঁধে বেরিয়েছিলাম পদ্মপুকুরের ছবি তুলতে।’
কিন্তু সেদিন পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করেনি। আসাফ পেয়েছিলেন দুরন্ত কিশোরকে। একগুচ্ছ পদ্মফুল হাতে কেবলই উঠেছে সে। আসাফ যেই না তাকে থামতে বললেন, বকা খাওয়ার ভয়ে ওই কিশোর ভোঁ দৌড়! আরও খানিকটা দৌড়ে বুঝেছিল, এ ‘প্রাণী’ বিপজ্জনক নন! থামল। আসাফ কাছে গিয়ে কায়দা করে ছেলেটাকে মডেল বানালেন। তোলা হলো একের পর এক ছবি।
সে ছবিটিই ইতালির ত্রেন্তো শহরের বিলবোর্ডে ঝুলেছে ৪ থেকে ১১ অক্টোবর। তবে ছবির গায়ে লেগেছে ২১তম রিলিজিয়ন টুডে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের প্রচারণাবাক্য। এটি ছাড়াও উৎসবের আনুষ্ঠানিক আলোকচিত্র হিসেবে আসাফের চারটি ছবি ব্যবহার করেন আয়োজকেরা। সেসব ছবি দিয়ে তৈরি করা হয় উৎসবের পোস্টার, বিলবোর্ড, প্রকাশনার প্রচ্ছদ। অনলাইন প্রচারণায় ব্যবহার করা হয় ছবিগুলো। শুধু তা–ই নয়, আসাফের ৩৩টি ছবি নিয়ে আয়োজন করা হয় একটি প্রদর্শনীরও।
পথ চিনিয়েছে ‘মিলান এক্সপো’
২০১৫ সালের কথা। ইতালির মিলান শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘মিলান এক্সপো’। এই আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে আসাফের সুযোগ হয়েছিল অংশ নেওয়ার। বিশ্বের ১১ জন আলোকচিত্রীর সঙ্গে তাঁর ছবিও প্রদর্শিত হয়ে মিলানের রাস্তায়। প্রদর্শনীর আয়োজক অরোরা ভিশনের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে তখন নিয়মিত যোগাযোগ ছিল আসাফের। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা রিলিজিয়ন টুডে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের উদ্যোক্তা। আসাফ বলছিলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী লিয়া বেলত্রামিসহ অনেকেই বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০১৭ সালে। ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিলাম তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে। সেখানেই তাঁরা প্রস্তাব দিয়েছিলেন আসছে উৎসবে আমার ছবি ব্যবহারের।’
সে কথা ভুলতেই বসেছিলেন। তাঁর কাছে ছবি চেয়ে গত মে মাসে হঠাৎ আনুষ্ঠানিক ই-মেইল করে প্রতিষ্ঠানটি। সঙ্গে জানায়, তারা প্রদর্শনী আয়োজনেও আগ্রহী। আসাফ ছবি পাঠান। ক্ষণগণনা করতে থাকেন উৎসবের।
ত্রেন্তো পর্ব
উৎসবটা চলচ্চিত্রের। নিজেদের চলচ্চিত্র নিয়ে সেখানে হাজির হয়েছিলেন ২৮টি দেশের পরিচালক, চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবু সেখানে বিশেষভাবেই থাকলেন আসাফ উদ দৌল্লা। গলায় ঝোলানো উৎসবের পরিচয়পত্র, যত প্রকাশনা, এখানে-সেখানে সাঁটানো পোস্টার কিংবা মঞ্চের ব্যাকড্রপ—সবকিছুতেই রয়েছে আসাফের তোলা ছবি। কৌতূহলী অনেকেই খোঁজ করছিলেন ছবির কারিগর কে। অনেকের মুখেই ঝরেছে প্রশংসাবাক্য। পরিচয়ে আপ্লুত হয়ে অনেককেই বলতে শুনেছেন—‘তুমিই সেই আলোকচিত্রী!’
আসাফ বললেন, ‘কয়েকটা দিন স্বপ্নের মতো কাটালাম। ইরান, রাশিয়া, কানাডা...এমন কত কত দেশের নামকরা পরিচালক। তাঁদের সঙ্গে পরিচিত হলাম। আমি নিজেই সুযোগ পেয়েছিলাম চলচ্চিত্রবিষয়ক এক কর্মশালায় অংশ নেওয়ার।’ আসাফের মতো ১৪ জন তরুণ অংশ নিয়েছিলেন সে কর্মশালায়। ছিলেন বাংলাদেশের তাসমিয়া আফরিনও।
‘বেলিসিমো’ বাংলাদেশ
বাংলাদেশ সম্পর্কে কজন ইতালীয় আর স্বচ্ছ ধারণা রাখেন! আসাফের আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে এমন অনেক দর্শনার্থী এসেছিলেন। একদিন এক নারী দর্শনার্থী এলেন। পুরো প্রদর্শনী দেখার পর কথা বললেন আলোকচিত্রীর সঙ্গে। আসাফ বলছিলেন, ‘ওই নারী এসেই আমাকে বললেন,“বেলিসিমো বাংলাদেশ।” ইতালীয় শব্দ বেলিসিমো মানে হলো অনেক সুন্দর। আবারও বললেন, “তোমার দেশ সম্পর্কে আমি খুবই কম জানতাম। ভালো লাগল ছবিগুলো দেখে।”’
দেখা করলেন পাওলো ক্রিস্টিনি
পাওলো ক্রিস্টিনি বিখ্যাত কেউ নন। ইতালীয় এই তরুণ সে দেশে একটি ব্যাংকের আইন পরামর্শক। থাকেন মিলানে। ২০১৫ সালের কথা। ইতালির একটি অনলাইন ম্যাগাজিনে চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ একটি ছবিতে চোখ আটকে যায় আইনজীবী পাওলো ক্রিস্টিনির। ‘মিলান এক্সপো’ শীর্ষক প্রদর্শনীর সেই ছবি পাওলোকে এতটাই আকৃষ্ট করে যে তিনি খোঁজ নেন চিত্রগ্রাহকের। ফেসবুকে খুঁজে নিয়ে আসাফকে জানান নিজের ভালো লাগার কথা।
সেই থেকে বন্ধুত্ব। এবার নিজের দেশে আসাফের প্রদর্শনীর কথা শুনে ২২০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এসেছিলেন দেখা করতে। এদিকে ভক্ত বন্ধুকে পেয়ে তো আসাফ মহাখুশি।
তৌকীর বললেন গর্বের কথা
রিলিজিয়ন টুডে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশ নিয়েছিলেন অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক তৌকীর আহমেদ। উৎসবে তাঁর পরিচালিত হালদা ছবিটি ‘গ্র্যান্ড পিক্স’ পুরস্কার অর্জন করে। উৎসবে দেখা পেয়েছিলেন আসাফের। আসাফ উদ দৌল্লার অর্জন সম্পর্কে বলছিলেন, ‘উৎসবে এটা খুবই আনন্দের ব্যাপার ছিল। আসাফের ছবিতেই উৎসবের পোস্টার করা হয়েছিল। অনেক কিছুতেই বাংলাদেশের উপস্থিতি ছিল। আমাদের ছেলেমেয়ের কাজ দেশের বাইরে প্রশংসিত হয়েছে, প্রদর্শিত হয়েছে, এটা গর্বের ব্যাপার।’
আসাফের ক্যামেরায় ‘সুখী বাংলাদেশ’
শৌখিন আলোকচিত্রী আসাফের আলোকচিত্রের হাতেখড়ি ব্যবসায়ী বাবা সামসুল আজমের কাছে। সামসুল আজম নিজেও ছিলেন শখের আলোকচিত্রী। আসাফ উদ দৌল্লা পেশায় এখন একজন প্রকৌশলী। প্রকল্প সমন্বয়ক হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠানের হয়ে একটি মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের ফোরজি নেটওয়ার্কের কাজ করেন। অফিসের ছুটিতে বেরিয়ে পড়েন ক্যামেরা হাতে। নিজের তোলা ছবি নিয়ে হাজির হয়েছেন প্রায় ৪০টি যৌথ প্রদর্শনীতে। আসাফ বলছিলেন, ‘ছবিতে আমি বাংলাদেশকে সুখী-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করি। আমার ছবির প্রধান বিষয় হচ্ছে হাসি।’
আসাফের কিছু ছবি দেখে সে কথার প্রমাণও মিলল। তবে কথা শেষ হতেই মনে করিয়ে দিলেন ক্যামেরা কাঁধে নেওয়ার শুরুর কথা। যখন দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের কষ্টের ছবি তুলতেন। একসময় আসাফের মনে নাড়া দিল—দেশের তো আরও ভালো কিছু, সুন্দর কিছু আছে। তিনি ছুটলেন সুন্দরের খোঁজে।