শেষ হলো তাঁর প্রতীক্ষা
তিনি বলেছিলেন, মৃত্যুর মাঝেই শেষ হবে তাঁর প্রতীক্ষা। ১৯ জানুয়ারি দুপুরে তাঁর সেই প্রতীক্ষা শেষ হলো। ৯৩ বছর বয়সে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন শহীদজননী সালেমা বেগম।
শহীদ লেফটেন্যান্ট সেলিম মোহাম্মদ কামরুল হাসানের মা সালেমা বেগম কিসের প্রতীক্ষায় ছিলেন, সেটা জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে আজ থেকে প্রায় ৪৬ বছর আগে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ মুক্ত হলেও তখনো দেশের কিছু অংশ পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীদের দখলে ছিল। ঢাকার মিরপুর এ রকম একটি এলাকা। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুর মুক্ত করতে গিয়ে শহীদ হন লেফটেন্যান্ট সেলিম। বিহারি অধ্যুষিত মিরপুরের ওই এলাকা থেকে সেলিমের মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। দেহাবশেষের কিছু অংশ পাওয়া গেলেও সেগুলো যে সেলিমেরই, সেটি নিশ্চিত হতে পারেননি তাঁর স্বজনেরা। প্রিয় সন্তানের অস্থিপঞ্জর একটিবার স্পর্শ করার জন্য তাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রতীক্ষায় ছিলেন সালেমা বেগম।
সালেমা বেগম এমন এক মা, যিনি তাঁর দুই ছেলেকে নিজের হাতে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। ২৫ মার্চ ঢাকা শহরে গণহত্যার বিভীষিকার পর তিনি তাঁদের যুদ্ধে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যেদিন তাঁরা বাড়ি ছাড়েন, সালেমা বেগম নিজে বাসার দরজা খুলে দিয়েছিলেন। ছেলেদের বিদায় জানানোর সময় বুকের মধ্য থেকে উঠে আসা কান্না চেপে রেখে তিনি বলেছিলেন, ‘যদি গুলি খাও, বুকে খাবে, পিঠে গুলি খাবে না, কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাবে না। আমি কোনো কাপুরুষের মা হতে চাই না।’
সালেমা বেগম তাঁর অপ্রকাশিত স্মৃতিকথায় লিখেছেন, যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ছেলেদের বিদায় জানানোর পর তিনি ও তাঁর স্বামী চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারেননি; তাঁরা অঝোর ধারায় কেঁদেছেন। সন্তানের ‘অনিশ্চিত যাত্রায়’ কোন মা নিজেকে কান্নাহীন রাখতে পারে?
সালেমা বেগম শুধু তাঁর ছেলেদের যুদ্ধে পাঠিয়ে ক্ষান্ত হননি, নিজেও নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। ১৯৭১ সালে তাঁর স্বামী ডা. এম এ সিকদার তেজগাঁও সেন্ট্রাল মেডিকেলের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্বামীর পেশাগত ওই অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে তিনি প্রায়ই আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা, আয়োডিন সরবরাহ করতেন। তাঁর ভাইয়ের এক রাজনৈতিক সহকর্মীর মাধ্যমে ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তিনি ৭৫০টি কম্বল পাঠিয়েছিলেন।
সালেমা বেগমের এ রকম একজন সাহসী নারী, আত্মত্যাগী মা হওয়ার নেপথ্যে একটি ইতিহাস আছে। ১৯২৫ সালের ১৮ নভেম্বর অবিভক্ত ভারতের আলমডাঙ্গা শহরে জন্ম নেওয়া সালেমা বেগম যখন স্কুলের ওপরের ক্লাসে, তখন তাঁর বড় ভাই (ডা.) সামসুর রহমান কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়তেন এবং স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই ভাই তাঁকে বিভিন্ন বইপত্র পড়তে দিতেন এবং স্বদেশি আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতেন। ভাইয়ের প্রেরণায় তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন। ১৯৪২ সালে দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় সালেমা বেগমের বিয়ে হয় তাঁর বড় ভাইয়েরই বন্ধু ডা. এম এ সিকদারের সঙ্গে। পারিবারিক আবহে তাই প্রগতির পক্ষে সারা জীবন কাজ করে গেছেন সালেমা বেগম। সন্তান হারানোর বেদনা থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পরও তিনি সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে অংশ নেন। নব্বইয়ের দশকে শহীদজননী জাহানার ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং বরিশাল বিভাগের প্রধান সংগঠক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন।
প্রিয় সন্তান, বড় ছেলে সেলিমকে হারিয়ে সালেমা বেগমের নিজের জন্য আর কিছু চাওয়া-পাওয়ার ছিল না। তিনি শুধু চেয়েছিলেন, সেলিমের অস্থিপঞ্জির একটিবার স্পর্শ করে তাঁকে বিদায় দেবেন। কিন্তু তাঁর সেই আশা কখনোই পূরণ হয়নি। সালেমা বেগম সারা জীবন তাই লাখো শহীদের মাঝে নিজের সন্তানকে খুঁজে বেড়িয়েছেন আর মুক্তিযুদ্ধের অধরা স্বপ্ন পূরণে নীরবে-নিভৃতেই কাজ করে গেছেন এবং সেভাবেই বিদায় নিলেন।