মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে ওরা, আপনিও আসুন

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল চালাচ্ছেন ‘চাল-ডাল-আলু; বাঁচার জন্য ৪৫০ টাকায় এক সপ্তাহ’ শীর্ষক একটি কার্যক্রম। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল চালাচ্ছেন ‘চাল-ডাল-আলু; বাঁচার জন্য ৪৫০ টাকায় এক সপ্তাহ’ শীর্ষক একটি কার্যক্রম। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

ভালোবাসাবাসির দিন তো প্রতিদিনই। তবু বসন্ত আলাদা। শীত শেষে প্রকৃতির নবজাগরণ সবাইকে ভালোবাসার বাণীতে অলক্ষ্যে অনুপ্রাণিত করে। এবারের বসন্ত অবশ্য আগের চেয়ে আলাদা। নারী-পুরুষের সরব উপস্থিতি নেই পথেঘাটে। যাঁরা আছেন বা থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁদের চোখেমুখেও শঙ্কার ছায়া। সতর্কতার চিহ্ন হয়ে মুখবন্ধ মাস্ক শুধু করোনাভাইরাসকেই প্রতিহত করছে না, বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে মানুষে-মানুষে হাসি বিনিময়েও।

কিন্তু বসন্ত চলে যাচ্ছে। চৈত্রের রোদে তেজ বাড়ছে। অথচ কেউ গেয়ে উঠছে না বসন্তের গান। শুধু গুনে যাচ্ছে নিশ্চিত সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা। ‘লকডাউন’, ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দগুলো যেন সব গিলে খাচ্ছে। শূন্য পথে ঝরে পড়া পলাশ-শিমুলও কী এক বিষণ্নতায় একা একা শুকিয়ে মরছে। চোয়ালশক্ত মানুষেরা যেন হাসতে ভুলে গেছে, গাইতে ভুলে গেছে। অথচ হাসি ও গানেরই বড় প্রয়োজন এখন।

অদ্ভুত সব খবর আসছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে রোগী ফিরে আসছে হাসপাতাল থেকে। অ্যাম্বুলেন্স ফিরে যাচ্ছে গুরুতর রোগীকে ফেলে রেখেই। সে রোগী পথেই মরে যাচ্ছে। আবার করোনাভাইরাস শনাক্তে পরীক্ষা করা হবে শুনে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাচ্ছে মানুষ। মানুষ মানুষের কাছে আসতে ভয় পাচ্ছে। এ এক অভূতপূর্ব বাস্তবতা। অথচ এমন তো হওয়ার কথা নয়। দুর্যোগেই তো ভালোবাসার প্রয়োজন পড়ে বেশি। কিন্তু এ এমন এক দুর্যোগ, যা মানুষকে তার চিরপরিচিত সমবেত হওয়ার আহ্বানের বদলে বলছে, ‘দূরত্ব মেনে চলো’।

রিকশাচালক মো. ইয়াসিন জানালেন তাঁর গ্যারেজ মালিক দেলওয়ারের কথা, যিনি এই দুর্যোগে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ছবি: লেখক
রিকশাচালক মো. ইয়াসিন জানালেন তাঁর গ্যারেজ মালিক দেলওয়ারের কথা, যিনি এই দুর্যোগে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ছবি: লেখক

না, সব একেবারে ভালোবাসাশূন্য হয়ে পড়েনি। বহু মানুষ ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পথে নেমেছেন। হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসকেরা এখনো নিষ্ঠার সঙ্গে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ত্রাণ বিতরণে সহায়তা করছেন নানা সংগঠন ও ব্যক্তিকে। সারা বিশ্বেই সব সময় এমন কিছু মানুষ থাকে।

বাংলা ‘কসাই’ শব্দটি সাধারণত নিষ্ঠুর অর্থে ব্যবহৃত হয়। অথচ এই কঠিন সময়ে ডেভ জোনস নামের এক ‘কসাই’ দেখিয়েছেন কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই মাংস বিক্রেতা আইসোলেশনে থাকা দরিদ্র প্রতিবেশীদের দুই সপ্তাহের খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে।

ঘরে বসে বসে ক্লান্ত হয়ে পড়া শিশুদের কথা মাথায় রেখে অনলাইনে আঁকা শেখাচ্ছেন মার্কিন টিভি উপস্থাপক নোয়েল ফিল্ডিং। কানাডায় ‘কেয়ারমংগারিং’ নামের একটি দল অনলাইনে মানুষকে শক্তি ও সাহস জোগানোর কাজ করছে। পাশাপাশি দরিদ্রদের খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছে। এমন বহু বহু উদাহরণ টানা যাবে।

এ তো গেল বিদেশের গল্প। এই বাংলাদেশে বড় সংগঠনগুলোর পাশাপাশি এমন বহু ছোট দল কাজ করছে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের কথা তো এখন সবাই জানে। হঠাৎ করে জনশূন্য এলাকায় পথের কুকুর ও বিড়ালদের খাওয়ার সংকট মেটাতে একজন ইসতিয়াক আহমেদের কথাও এখন অজানা নয়।

এই ইসতিয়াক আহমেদের সঙ্গে হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়। রাজু ভাস্কর্যের পাশের রাস্তায় নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে বেশ কিছু মানুষকে বসে থাকতে দেখে থামতে হলো। ছবি তোলার পর উদ্যোক্তাকে খুঁজতেই দেখা মিলল ইসতিয়াকের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। জানালেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি খাদ্য ও ওষুধ বিতরণের কাজটি করছেন। কতজন রয়েছেন এখানে? এ প্রশ্নে জানালেন, ‘আমার ক্ষমতা তো বেশি নয়। মাত্র ৬০ জনকে দিতে পারছি।’ কী করে বলব তাঁকে, সংখ্যা দিয়ে তাঁর ক্ষমতা বিচার সম্ভব নয়।

দরিদ্রদের মধ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে খাদ্য ও ওষুধ বিতরণ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইসতিয়াক আহমেদ। ছবি: লেখক
দরিদ্রদের মধ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে খাদ্য ও ওষুধ বিতরণ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইসতিয়াক আহমেদ। ছবি: লেখক

এখানে বলা যায় ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বলের কথা, যিনি ‘চাল-ডাল-আলু; বাঁচার জন্য ৪৫০ টাকায় এক সপ্তাহ’ শীর্ষক একটি কার্যক্রম শুরু করেছেন। বলা যায় পিনাক রায়ের নেওয়া ‘করোনাকালে হাওরের ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে মানুষ’ উদ্যোগের কথা। এমন বহু উদ্যোগ নিচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। নির্দিষ্ট কোনো সংগঠনের বাইরের এই উদ্যোগগুলো এক ভীষণ আশার সঞ্চার করে। বলা যায় হাজারিবাগের রিকশা গ্যারেজের মালিক দেলোয়ারের কথা, যিনি তাঁর গ্যারেজের রিকশাচালকদের খাবার দিচ্ছেন। তাঁর কথা বলছিলেন রিকশাচালক মো. ইয়াসিন। জানালেন, গ্যারেজের জমা এখন আর আগের মতো নেই। যে যেদিন যেমন পারে, তেমন জমা দেয়। না পারলে নাই। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষদের জন্য এ যে কত বড় সাহায্য—তা বলে বোঝানো যাবে না।

করোনা-আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সন্দেহে লাশ দাফনেও অনেক সংকট হচ্ছে। এই সংকট মোকাবিলায়ও এগিয়ে এসেছেন এক দল তরুণ। তাঁরা বলছেন, ‘করোনা-আক্রান্ত হওয়াটা কোনো অপরাধ নয়। আক্রান্ত হয়ে যাঁরা মারা গেলেন, তাঁরা অচ্ছুত নন। এটি একটি অসুখ শুধু। দুর্ভাগ্য এই যে, এর ওষুধ আমাদের কাছে নেই এখনো।’ এই তরুণেরা, এই মানুষেরা আতঙ্কিত বিপর্যস্ত মানুষকে ভালোবাসার কথাই জানিয়ে দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, ‘পাশেই আছি।’ তাঁরা বলছেন, ‘করোনার বিস্তার রোধে সবাই ঘরে থাকুন। আমরা আপনাদের প্রয়োজন যথাসাধ্য মেটানোর চেষ্টা করব।’ এই মানুষেরাই এ বসন্তের প্রতীক। এ মানুষেরাই এ বসন্তের গান, যারা শূন্য চোখে ঘুরে বেড়ানো মানুষদের একটু আশার আলো দিচ্ছেন।

করোনাভাইরাসের বিস্তার ও এতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর সবাইকে শঙ্কিত করে তুলেছে। এটি এই সংকটের একটি দিক। আরেকটি দিকও কিন্তু আছে। সংকটের এই সময়ে আমরা বরং সেই দিকেই তাকাই না হয়। এই সংকট কিন্তু সপরিবারে বসে গল্প করার সময় করে দিয়েছে। ঘরের চালের নিচে কিংবা শহুরে বাসার বারান্দায় অলক্ষ্যে বাসা বাঁধা চড়ুইয়ের ডাকে কান পাতার ফুরসত এনে দিয়েছে। এই সংকট কিন্তু গোটা পৃথিবীকে এবং তার একটি ক্ষুদ্র প্রাণ হিসেবে মানুষকে একটু শ্বাস ফেলবার সময় এনে দিয়েছে। এও কি কম!

এত সবুজ নগরী আগে আর কবে দেখা গেছে? করোনাভাইরাস সৃষ্ট সংকটের এই সময়ে একেও তো একটি পাওয়াই বলতে হবে। ছবি: লেখক
এত সবুজ নগরী আগে আর কবে দেখা গেছে? করোনাভাইরাস সৃষ্ট সংকটের এই সময়ে একেও তো একটি পাওয়াই বলতে হবে। ছবি: লেখক

ঢাকা মহানগরের কথাই যদি ধরা হয়, তবে এই শহরে এই বসন্তে এত সবুজ কে দেখেছে কবে? আগেও শীত শেষে গাছে গাছে পাতা গজাত। কিন্তু কই, ধুলো তো সব ঢেকে দিত। চোখের সামনে পর্দা হয়ে দুলত পুরোনো সেই মলিন দৃশ্যই। এ তো সেই ঢাকা, যেখানে গাড়ির হর্ন প্রতি বসন্তে গিলে খেত কোকিলের ডাক। অথচ এই সেদিন মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচে ঠিকই মিলল পাখিদের আলাপ। কে জানত এই নগরে শুধু গাড়ি নয়, শুধু ব্যস্ত মানুষেরাই নয়, পাখিরাও থাকে, থাকে সবুজও!

করোনাভাইরাসের এই মহামারি যে নিস্তব্ধতা এনে দিয়েছে শহরে, তা প্রাণকে আইঢাই করে তুলতে চাইবে। কিন্তু এই পাওনাগুলোর দিকে তাকালে একটু তো উপশম হবে। ঘরবন্দী মানুষেরা চলুন আমরা এই প্রাপ্তিগুলোর দিকে তাকাই। আসুন আতঙ্ক নয়, সাহসের কথা বলি। আসুন সবাইকে আশ্বস্ত করি। আসুন এই নিদানে গানের কথা বলি, ছবির কথা বলি, বলি পাখিদের কথা, সবুজ বনভূমির কথা, বলি সেই সব আয়োজনের কথা—এই নিদাঘ পেরোলেই যা আমরা করতে বেরোব। আসছে বৈশাখে হয়তো শোভাযাত্রা করে সর্বমঙ্গলের কথা বলা হবে না। কিন্তু মানুষের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষাকে কে কবে রুখতে পেরেছে? করোনাভাইরাসও পারবে না। বৈশাখের শুরুর ক্ষণে আবারও আমরা শরণ নেব রবীন্দ্রনাথের, গেয়ে উঠব মঙ্গল গান। সঙ্গে সাহস ও আশ্বাসের গান গাইব আমরা। আসুন ভালোবাসি, ভালোবাসার কথা বলি—এটাই ভালোবাসবার সময়।

ফজলুল কবির: প্রথম আলোর সাংবাদিক
ই-মেল: fazlul.kabir@prothomalo.com