আমাদের জীবনে এবারের খ্রিষ্টীয় নববর্ষ বহুমাত্রিক তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়েছে। একুশ শতকের প্রথম দুই দশক পূর্তি এবং আরেকটি নতুন দশকের সূচনালগ্নে আমরা সার্বিকভাবে নজর দিতে পারি বৈশ্বিক উন্নয়ন ও মানবজাতির জন্য চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে। আগামী ১৭ মার্চে আমরা পদার্পণ করব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে। আর সব মিলিয়ে গোটা বছরটি ক্রমাগতভাবে আন্দোলিত ও আলোড়িত হতে থাকবে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের মাহেন্দ্রক্ষণ সামনে রেখে।
বর্তমান বিশ্ব এক অসামান্য অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিগত শতকের শেষের দিকে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সমতা, বৈষম্যমুক্তকরণ ও মানবাধিকার পরিস্থিতির ক্ষেত্রে যে বড় অগ্রগতি সূচিত হয়েছিল, সেগুলো গত দুই দশকে পিছু হটেছে। এই সময়ের মুখ্য বৈশিষ্ট্য হলো, পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল হওয়া। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থায় পরিচালিত দেশগুলোতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতৃত্বের নৈতিকতা ও মানবিকতার সংকট তীব্র হয়েছে।
দুই দশকের শেষ প্রান্তে বিশ্বব্যাপী বিদগ্ধজনেরা নতুন করে শাসনব্যবস্থার কার্যকরতা নিয়ে ভাবতে বসেছেন। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের তিনটি পৃথক স্তম্ভ এবং নিয়মিত বিরতিতে যে নির্বাচননির্ভর শাসনব্যবস্থা, বিশ্ব যাকে এতকাল শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা হিসেবে ভেবে এসেছে, তাতে ধস নেমেছে। ব্যতিক্রম বাদে কর্তৃত্বপরায়ণবাদিতা মোটামুটি বৈশ্বিক প্রবণতায় দাঁড়িয়ে গেছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের স্লোগান দিয়ে মানুষে মানুষে ভেদাভেদকে শাণিত করার প্রবল চেষ্টা চোখে পড়ে। ব্রেক্সিট, উন্নত দেশগুলোতে অভিবাসন নীতির কড়াকড়ি এবং বাক্স্বাধীনতাবিরোধী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ছড়াছড়ির মধ্যে বিশ্বে আপাতত দক্ষিণপন্থীদের প্রাধান্য স্পষ্ট। উদার জাতীয়তাবাদ মানুষের মুক্তির মন্ত্র হতে পারে। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশের অভ্যুদয়। কিন্তু আজ চারদিকে এর উল্টো চিত্রই পরিলক্ষিত। কট্টর জাতীয়তাবাদীরা রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের পরিচয়কে বড় করে তুলছে। অবশ্য আপাতত তাদের সফল মনে হলেও এটি যে মানবসভ্যতা বিকাশের অন্তরায়, তা হলফ করে বলা যায়। নতুন বছরে বিশ্বনেতাদের বিবেকবান অংশকে তাই সাম্য, ন্যায়বিচার ও বৈষম্যমুক্ত বিশ্ব গড়ার সংকল্প করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও বর্ণবাদী নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত অভিবাসন নীতি রোধে জাতিসংঘকে নতুন করে সংকল্প নিতে হবে।
২০১৯ সালে আমাদের জাতীয় জীবনে নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধার, প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক বোঝাপড়া, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে অপারগ থাকা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালী হওয়া বা সামর্থ্য বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো অমীমাংসিত থেকেছে। ফেনীর নুসরাত, বুয়েটের আবরার হত্যাকাণ্ড ও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মতো ঘটনাবলি নির্দেশ করছে যে, সর্বস্তরে ধারাবাহিক শুদ্ধীকরণ সময়ের দাবি।
সংসদীয় গণতন্ত্র ও যৌথ জবাবদিহির ধারণা নিষ্প্রভ হতে চলেছে। রেমিট্যান্স বাদে অন্যান্য অর্থনৈতিক সূচকগুলো নিম্নমুখী। বছরের শেষে পেঁয়াজ বেশ ভুগিয়েছে, চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। অবশ্য এসব কিছু ছাপিয়ে বিদায়ী বছরে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন, বিশেষ করে মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের ধারা অব্যাহত থেকেছে। বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগকারী ও বিশ্লেষকদের কাছে তার উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হওয়ার ভাবমূর্তি ধরে রেখেছে। পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্যের কূটনীতি প্রশংসার দাবিদার। অবশ্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অগ্রগতি আসেনি। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গাম্বিয়ার মামলাটিকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখা যায়। ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটি দুই প্রতিবেশীর সুসম্পর্কে আকস্মিক ছন্দপতন ঘটিয়েছে। এর যথা প্রতিকারের দায় দিল্লির ওপরই বর্তায়।
নতুন বছরটি কল্যাণময় হোক। বাক্স্বাধীনতা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও পরমতসহিষ্ণুতায় ঋদ্ধ হোক বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আইনের শাসন সুদৃঢ় করার বিকল্প নেই।