দুর্যোগে সব সামলান নারী, নাম হয় পুরুষের!

ঘূর্ণিঝড় আসছে। ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। সবাই ব্যস্ত জান বাঁচাতে। আশ্রয়কেন্দ্র বা উঁচু কোনো ভবনে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি। কিন্তু আমার মা টিউবওয়েলের হাতলটা খুলে রাখলেন। খোলা মাথাটা পলিথিন দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিলেন। কিছু কাঠ-কয়লা এমন জায়গায় রাখলেন যেন জলোচ্ছ্বাসেও ভিজে না যায়। কিছু চাল-ডাল-মাছ বড় বড় হাঁড়িতে রেখে ভালো করে মুখ বন্ধ করে মাটির নিচে সংরক্ষণ করলেন। তখন ঝড়-জলোচ্ছ্বাস শুরু হয়ে গেছে। প্রতিবেশী একজনের হাত ধরে আশ্রয় নিলেন একটা উঁচু পাকা ভবনে।
সারা রাতের তাণ্ডবে সবকিছু লন্ডভন্ড। সকালে কী খাবে বাসার সবাই? সেই সময় মা এসে ধীরেসুস্থে টিউবওয়েলের হাতলটা লাগিয়ে পানি তুললেন। কাঠ-কয়লা দিয়ে চুলা ধরালেন। ডাল-ভাত রান্না করলেন। এমনকি গরম-গরম মাছভাজাও দিলেন ছেলে ও তার বাবার পাতে। কিন্তু সেই মা কি তখনো খেয়েছেন? কেউ খোঁজ রাখিনি।
এই বিবরণ সেদিন দিচ্ছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহাম্মদ। তিনি প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছিলেন প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠকে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় আয়োজিত ওই আলোচনা অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল জলবায়ু সহনশীলতায় গ্রামীণ নারীর ভূমিকা। রফিক আহাম্মদ তাঁর ছোটবেলার স্মৃতিকথা বলছিলেন। তিনি বললেন ’৭০-এর সেই ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে অনেক মানুষ প্রাণ হারায়। তাঁদের গ্রামের অনেকে সেই সময় দুর্যোগের পর কয়েক দিন অসহায় অবস্থায় ছিলেন। নাওয়া-খাওয়া নেই। থাকার ঘর নেই। কিন্তু মা জানতেন এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করতে হবে। তাই এত বড় জলোচ্ছ্বাসের পরও তিনি তাঁর মায়ের হাতে গরম ভাত-মাছ-ডাল খেতে পেরেছেন। কথাটা তাঁর স্মৃতিতে গেঁথে আছে।
আমরা কথায় বলি নারীর ক্ষমতায়ন দরকার। এমনকি বলি, এখন নারীর ক্ষমতায়ন অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। ঘরদোর সামলান নারী। দুর্যোগে সব বিপদ-আপদ থেকে বাঁচার উপায় বের করতে হয় তাঁকেই। আর পরিবারের প্রধান হিসেবে পুরুষের খবরদারিটাই শেষ পর্যন্ত আসল ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সব ক্রেডিট জমা হয় পুরুষের খাতায়। নারীর কাজের মূল্যায়ন হয় না। এভাবে নারীর ক্রেডিট হাইজ্যাক হয়ে চলেছে গ্রামে গ্রামে, ঘরে ঘরে।
অনেক নারী আজকাল কৃষিকাজ করেন মাঠে। কারণ, পুরুষ হয়তো আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে ইজিবাইক চালান বা কাছের ইউনিয়ন সদরে দোকানে কাজ করেন। মাঠে কাজ করেন নারী। কিন্তু কৃষি কার্ড পান স্বামী। সেই কার্ডে ঋণ পান তাঁর স্বামী। কারণ, জমি স্বামীর নামে। তাই কৃষি কার্ডও তাঁরই নামে। তাহলে নারীর ক্ষমতায়নটা হলো কীভাবে?
অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলছিলেন, আগামী ১০০ বছরে দেশের দক্ষিণাঞ্চল তিন ফুট পানির নিচে চলে যাবে। অবশ্য উঁচু বাঁধের কারণে হয়তো সব এলাকা ডুবে যাবে না। কিন্তু বেশ কিছু এলাকায় লবণাক্ততা বেড়ে যাবে। খাওয়ার পানির সংকট দেখা দেবে। সেই সঙ্গে দেখা দেবে জ্বালানি ও খাদ্যসংকট। মানুষ বাঁচবে কীভাবে?
তাই এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। কাজটা শুরু করতে হবে এখনই। রিভার্স অসমোসিস প্রক্রিয়ায় পানি শোধন করে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা, লবণাক্ত পানিতে সহনশীল ধানের উদ্ভাবন ও প্রচলন—এগুলো এখন আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ। যদি করতে পারি, টিকতে পারব। আর না হলে আমাদের জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে বিদায় নিতে হবে।
এখানে দুর্যোগ সহনশীলতায় নারীর একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। দুর্যোগের সময় প্রাথমিক ম্যানেজার নারী। এই গুরুত্বপূর্ণ সত্য কথাটি বললেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জেন্ডার অ্যাডভাইজার বনশ্রী মিত্র নিয়োগী। শস্য, জ্বালানি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নারীর ভূমিকা অবিকল্প। তাঁর ওপর এত বোঝা, তা–ও তিনি ঘুরে দাঁড়ান।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম একটা বড় কথা বললেন। নারীকে সম্মান দিতে হবে। সংসারের কাজ, মাঠের কাজ, চুলায় চোখ পুড়িয়ে রান্নার কাজ, এমনকি ধান বোনা-কাটা-মাড়াই প্রায় সব কাজই করেন নারী। কিন্তু এসব কাজের বেতন পান না বলে তাঁর কাজের স্বীকৃতিও নেই। তাই মর্যাদা পান না। অথচ এই নারীই দুর্যোগে টিকে থাকার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে প্রতিদিন একমুঠো করে চাল সংরক্ষণ করেন। পরিবারের আর কার মাথায় এমন বুদ্ধি খেলে?
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন একটি ছোট পদ্ধতির প্রবর্তন করেছে। লবণাক্ত পানি থেকে সুপেয় পানি তৈরির ব্যবস্থা। এটা একটা মডেল হতে পারে। সরকার বা কোনো বেসরকারি শিল্পোদ্যোক্তা এর ব্যাপক উৎপাদন করে স্বল্পমূল্যে বাজারজাত করতে পারে। তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বড় অভিশাপ পানির অভাব দূর হবে। এটা নারীরই কৃতিত্ব। কারণ, এসব বিষয় নিয়ে নারীই সবচেয়ে বেশি কাজ করছেন।
আমরা জানি না আগামী দিনে কত বড় দুর্যোগের মুখে পড়তে চলেছি। বিশ্ব বায়ুমণ্ডলের উষ্ণায়ন বেড়ে চলেছে। এটা থামানোর চেষ্টা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে গেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদনের চেয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বেড়ে চলেছে।
হয়তো বড় কোনো আবিষ্কার, নতুন কোনো প্রযুক্তি ব্যতিক্রমী পরিবর্তন আনতে পারে। যেমন, গতকালের প্রথম আলোয় দেখলাম কানাডার কয়েকজন বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, তাঁরা এমন এক ধরনের পরিবেশবান্ধব কৃত্রিম পাতা আবিষ্কার করেছেন, যা গাছের সবুজ পাতার মতোই বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেন জ্বালানি তৈরি করবে। গাছের পাতা বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে তার খাদ্য বানায়, অক্সিজেন বাতাসে ফিরিয়ে দেয়। আর নতুন আবিষ্কৃত কৃত্রিম পাতা বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড ভেঙে মিথানল ও অক্সিজেন তৈরি করবে। পরে সেই মিথানল বিশেষ প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
কিন্তু এসব ভবিষ্যতের কথা। কবে সেই সুবাতাস বইবে, সেই দুরাশায় আমরা বসে থাকতে পারি না। আমাদের এখনই এমন কাজ করতে হবে যেন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যায় আমরা বেঁচে থাকতে পারি। আর এর কলাকৌশল সবচেয়ে বেশি জানেন গ্রামীণ নারী। তাঁকে সামনে নিয়ে আসতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম : প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
quayum.abdul@prothomalo.com