বিশ্বব্যাংকের ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ বা ব্যবসার পরিবেশ সহজীকরণ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ আট ধাপ এগিয়েছে। এই তথ্য গত কয়েক বছরের সঙ্গে তুলনা করলে কিছুটা স্বস্তিদায়ক বলা যায়। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় একে বড় ধরনের অগ্রগতি বলা যাবে না। ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম। অর্থাৎ, আমরা পেছনের সারিতেই রয়ে গেছি। একই সময়ে পাকিস্তান এগিয়েছে ২৮ ধাপ, ভারত ১৪ ধাপ। আরও হতাশার খবর হলো দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে এখনো বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। অর্থাৎ, একমাত্র আফগানিস্তানের চেয়ে আমরা এগিয়ে আছি।
এর পাশাপাশি দেশীয় ব্যবসায়ীদের গবেষণা সংস্থা বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) প্রকাশিত ব্যবসার আস্থা সূচকে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের চেয়ে পরের ছয় মাসে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। জানুয়ারি-জুনে আস্থা সূচক ছিল ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ, জুলাই-ডিসেম্বরে ১০ দশমিক ৮৭ হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। কর্মসংস্থানের অবস্থা, দ্রুত লাইসেন্সপ্রাপ্তি, টার্নওভার করের সীমা বৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতির কারণে এটি হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ১০টি সূচকের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে, যার মধ্যে রয়েছে ব্যবসা শুরু, নির্মাণ অনুমোদন, বিদ্যুৎপ্রাপ্তি, সম্পত্তি নিবন্ধন, ঋণপ্রাপ্তি, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর স্বার্থরক্ষা, কর পরিশোধ, সীমান্ত বাণিজ্য, চুক্তি কার্যকর ও দেউলিয়াত্ব মীমাংসা। বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ব্যবসা শুরুর সূচকটি পরিমাপ করা হয় ব্যবসার বাণিজ্যিক বিরোধ মেটাতে প্রয়োজনীয় সময় ও ব্যয় এবং এ-সংক্রান্ত আইনি পদ্ধতির গুণগত মানের ওপর ভিত্তি করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশে সময় লাগে ১ হাজার ৪৪২ দিন এবং ব্যয় হয় বিরোধে দাবি করা মোট অর্থের ৬৬ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ অর্থনীতির সার্বিক সূচকে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানেও এর চেয়ে কম সময় লাগে। সম্পত্তি নিবন্ধনেও বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল; ২৯ নম্বর পেয়ে ১৮৪তম। তবে বিদ্যুৎ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি আছে। একসময় পালা করে কারখানা বন্ধ রাখতে হতো। এখন আর সেই অবস্থা নেই। ঋণ পাওয়ার সূচকে যে অগ্রগতি হয়েছে, তার স্বীকৃতি আছে বিল্ডের প্রতিবেদনেও।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান স্বীকার করেছেন, ব্যবসা সহজীকরণে আগে তেমন কাজ হয়নি। বিগত
নির্বাচনের পর বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে এবং কিছু ফলও পাওয়া গেছে। এর অর্থ আমরা আরও আগে উদ্যোগ নিলে ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। প্রতিবছরই বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সূচকে ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যাগুলো শনাক্ত করা হয়ে থাকে। নীতিনির্ধারকেরা দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের প্রতি আরও বেশি বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে থাকেন। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যাগুলো দূর না হলে তাঁরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবেন না। অন্য দেশে চলে যাবেন। সব দেশই এখন বিনিয়োগের জন্য উন্মুখ।
মন্ত্রী-উপদেষ্টারা বলেছেন, সরকার ব্যবসা সহজীকরণ সূচককে দুই অঙ্কের ঘরে, অর্থাৎ ১০০-এর নিচে নিয়ে আসতে চায়। এটি করতে হলে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার, দুর্নীতি, অনৈতিক লেনদেন, পরিবহন খরচসহ যেসব বিষয়ে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ আছে, সেগুলো নিরসনে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমরা যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছি, প্রতিবেশীরা তখন জোরকদমে দৌড়াচ্ছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমাদেরও সমান গতিতে চলতে হবে। অন্যথায় আমরা আরও পিছিয়ে পড়ব।