সরকারপন্থী ছাত্রলীগের অনুগত নয় এমন যেকোনো শিক্ষার্থী যেকোনো কারণে নির্যাতনের শিকার হতে পারেন, এমনকি আবরারের মতো প্রাণও হারাতে পারেন—এই ব্যবস্থা এক দিনে গড়ে ওঠেনি; দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ও আবাসিক হলগুলোর প্রাধ্যক্ষরাসহ পুরো প্রশাসনের জ্ঞাতসারেই তা ঘটেছে। প্রশাসনিক পদে নেই এমন শিক্ষকেরাও এই নিষ্ঠুর ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন। এই নির্যাতনব্যবস্থা এতটাই জবরদস্ত যে এর কাছে দেশের আইনকানুন ও থানা-পুলিশও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। রোববার রাতে শেরেবাংলা হলে যখন আবরারকে নির্যাতন করা হচ্ছিল, তখন খবর পেয়ে চকবাজার থানার একজন উপপরিদর্শক তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে শেরেবাংলা হলের গেটে গিয়েছিলেন। ছাত্রলীগের বাধা পেয়ে পুলিশ কর্মকর্তা সেখানে এক ঘণ্টা বসে থাকার পর ফিরে যান। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও আইন প্রয়োগের ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দিয়ে যে নির্যাতনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা কীভাবে ও কিসের জোরে গড়ে উঠতে পেরেছে, তা একটা গভীর প্রশ্ন।
শুধু তা-ই নয়, শেরেবাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ, যিনি ওই ছাত্রাবাসের বাসিন্দা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাসহ সব রকমের দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত, তিনিও তাঁর একদল শিক্ষার্থীর নৃশংস আক্রমণের হাত থেকে আরেক শিক্ষার্থীর জীবন রক্ষার জন্য কোনো ভূমিকাই পালন করেননি। আর প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বড় অভিভাবক, উপাচার্য সাইফুল ইসলাম আবরার হত্যার পর দীর্ঘ সময় ধরে ক্যাম্পাসে হাজির হওয়া থেকে বিরত ছিলেন। এত বড় মর্মান্তিক ঘটনায় উপাচার্য হিসেবে তাঁর তরফে যে নূ্যনতম সংবেদনশীলতার প্রকাশ প্রত্যাশিত ছিল, তার দৃশ্যমান অভাব শিক্ষার্থীদের সংগতভাবেই ক্ষুব্ধ ও হতাশ করেছে।
বুয়েটে সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের নিষ্ঠুর দুর্বৃত্তপনার যে স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, উপাচার্যসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তার দায় নিতে হবে। এই নির্যাতনব্যবস্থা স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করার উদ্যোগ নেওয়া একান্ত জরুরি। শিক্ষার্থীরা যে ১০ দফা দাবি উত্থাপন করেছেন, তার অন্যতম হলো আবাসিক হলগুলোতে র্যাগিংয়ের নামে ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনসহ সব ধরনের নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। বুয়েট শিক্ষক সমিতি অদক্ষতা ও নির্লিপ্ততার অভিযোগে উপাচার্য সাইফুল ইসলামের পদত্যাগ দাবি করেছে, বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনও উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেছে। একই সঙ্গে এই সব পক্ষের তরফেই বুয়েটে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে।
বুয়েটে চলমান অস্থির পরিস্থিতির দ্রুত অবসান ঘটিয়ে পড়াশোনার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। সে জন্য শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দাবিগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। সেখানে সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম ও দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা নির্যাতন ও র্যাগিংয়ের সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। বুয়েটের বর্তমান প্রশাসনের মাধ্যমে যে এটা সম্ভব হবে না, তা পরিষ্কার। উপাচার্য সাইফুল ইসলামকে তাই পদত্যাগ করতে হবে। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ও অযোগ্য হল প্রাধ্যক্ষদেরও সরে যেতে হবে। বুয়েট নিয়ে সব পক্ষের মধ্যে যে উপলব্ধি হয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে সবকিছু নতুনভাবে শুরু করার উদ্যোগ নিতে হবে।