সরকারি চাকরি আইনকে সাধারণভাবে আমরা স্বাগত জানাই। ৪৭ বছর ধরে ঝুলে থাকা একটি সাংবিধানিক অঙ্গীকার অবশেষে পূরণ করা হয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংসদ সংবিধানের বিধানাবলি-সাপেক্ষে কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কিন্তু এটি এতকাল অপূরণীয় থেকে গেছে। এই বিষয়ে বিচ্ছিন্নভাবে করা অর্ধডজন আইন, যার তিনটিই সামরিক ফরমান ছিল, নতুন আইন কার্যকর হওয়ার
তারিখ থেকে সেগুলো বিলোপ করা সম্ভব হলো। কিন্তু আইনটিতে অভিযুক্ত কর্মচারীদের ফৌজদারিতে সোপর্দ করার বিষয়ে একটি অসংগত বিধান দুঃখজনকভাবে যুক্ত করা হলো। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্টতই প্রশাসনিক দুর্নীতির বিষয়টিকে প্রকারান্তরে উৎসাহিত করা হয়েছে। একটি ভালো আইনের মধ্যে এ রকম একটি কালো বিধানের সন্নিবেশ সরকারের ঘোষিত নৈতিকতা ও শুদ্ধাচার কৌশলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আইনটি জনগণকে অনেক হতাশার মধ্যেও আশান্বিত করতে পারে। কারণ, আইনটি বলেছে, মেধা ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা হবে নিয়োগের ভিত্তি। আর সততা, মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতাই হবে পদোন্নতির পূর্বশর্ত। কিন্তু আগের ধারাবাহিকতায় প্রশাসনে দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকেছে। মানুষ বহুক্ষেত্রে সেবাবঞ্চিত থাকছে। দুর্নীতি, দলীয়করণ ও গোষ্ঠীগত তোষামোদি হয়ে পড়েছে নিয়মনীতি। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে নতুন আইনটি এসেছে। এখন দরকার সৎ রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এ ছাড়া সুশাসন শুরু করা কঠিন হবে।
সুশাসন বিষয়ে নতুন আশাবাদ কঠিন। কারণ, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজেদের জন্য অবলীলায় একটি মানহানিকর ও আদালতের জন্য অবমাননাকর বিধান তৈরি করলেন। এখন অবস্থা দঁাড়াল, জনপ্রতিনিধি হলে পুলিশ তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করতে পারবে, কিন্তু সরকারি কর্মচারী হলে পারবে না। আবার পরিহাস হলো, এই দায়মুক্তির সুবিধা শুধু আইনভুক্ত সরকারি চাকুরেরা পাবেন, অন্যরা নন। সংবিধান দ্বারা সৃষ্ট কোনো চাকরি বা পদধারী, স্বশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি ক্ষেত্রের কর্মরতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ এলে কোনো দায়মুক্তি থাকবে না। অর্থাৎ সরকারের ভেতরে একটি খাসমহল তৈরি করা হয়েছে। সরকারি খাতের চাকুরেদের মধ্যেও এ রকম বৈষম্যমূলক বিধান সমতার নীতিকে আঘাত করে।
সম্ভবত আমলাতন্ত্রের অসাধু অংশের চাপেই এ রকম একটি কালো বিধান যুক্ত হলো। দুর্নীতি দমন ব্যুরো নামের প্রতিষ্ঠানটি অকার্যকর হয়েছিল এই দায়মুক্তির কারণেই। ২০০৪ সালে উন্নয়ন-অংশীদারদের সমর্থনে ও আনুকূল্যে পাস হলো দুদক আইন। এতে সবার জন্য শুধু দুদকের অনুমোদনকেই অপরিহার্য করা হলো। কিন্তু ২০১৩ সালে সংসদে দুদক আইনে ৩৫(ক) যুক্ত করে সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে সরকারের পূর্বানুমোদনের বিধান আবারও ফিরিয়ে আনা হলো। এর বৈধতা হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ হলে আমরা আশা করেছিলাম, সরকার নতি স্বীকার করবে। সেটা তারা করেনি। সরকার হাইকোর্টে মামলা লড়ে হেরে গেছে। কেন সরকারি কর্মচারীদের বাঁচাতে হবে, সেটা রাষ্ট্র উচ্চ আদালতে ব্যাখ্যা করেছে। কিন্তু তারা সেখানে পরাস্ত হয়েছে। আদালত ৩৫(ক) ধারাটিকে অসাংবিধানিক বলে বাতিল করেছেন। এরপরই শক্তিশালী আমলাতন্ত্র নতুন কৌশল এঁটেছে। এখন নতুন আইনের ৪১ ধারা যুক্ত করে সংসদ ও সরকারকে সুপ্রিম কোর্টের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী নতুন আইনের সমর্থনে ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কুইক রেন্টালের মতো যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করার দায় রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকদের। এ রকম প্রকল্প কর্মচারীদের দ্বারা বাস্তবায়নে তঁাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি দায় আনার প্রশ্নই আসে না। অবশ্য দুদক যুক্তি দিতে পারে, ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে ‘সরকারি দায়িত্ব’ পালনের কোনো সম্পর্ক নেই। আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ আহরণের দায়ে কাউকে গ্রেপ্তার করতে হলে নতুন আইনের সুরক্ষা তাকে বঁাচাতে পারবে না বলেই প্রতীয়মান হয়।