আদালতকক্ষে বার-বেঞ্চের কথোপকথন ‘কোর্টের সম্পদ’ বিবেচনা করা যুক্তিসংগত নয়। তাই এ ধারণার বশবর্তী হয়ে প্রেস কাউন্সিলের তরফে সংবাদমাধ্যমে এজলাসের কথোপকথন প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের খবরটি অনভিপ্রেত। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল সম্ভবত এ বিষয়ে একটি অসতর্ক ভুল করেছে। তারা এটা অনতিবিলম্বে শুধরে নেবে বলেই আমরা আশা করি। প্রেস কাউন্সিলের এ–সংক্রান্ত বিভ্রান্তকর বিজ্ঞপ্তি এমন একটি সময়ে এসেছে, যখন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের পদটি শূন্য। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদের চেয়ারম্যান পদে থাকার মেয়াদ গত ২২ আগস্ট শেষ হয়েছে। এ অবস্থায় সাংবাদিকবান্ধব একটি আধা বিচার বিভাগীয় সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রেস কাউন্সিল থেকে কী করে এমন একটি বাক্স্বাধীনতাবিরোধী বিজ্ঞপ্তি বেরোল, সেটা এক বিরাট রহস্য বটে।
বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল বলেছে, ‘এজলাস চলাকালীন বিচারক ও আইনজীবীদের মধ্যে কথোপকথন বা যুক্তিতর্ক একান্তভাবে কোর্টের সম্পদ এবং এটি সংবাদপত্রে প্রকাশযোগ্য নয়।’ এ দেশে এমন অস্বাভাবিক মন্তব্য এর আগে কখনো কেউ করেছে বলে আমাদের জানা নেই। সব থেকে বিস্ময়কর যে প্রেস কাউন্সিল কোন প্রেক্ষাপটে এমন বিজ্ঞপ্তি দিল, সেটা পরিষ্কার নয়। তারা একটি হাইকোর্টের রায়ের দোহাই দিয়েছে, কিন্তু কোন রায়ে এ কথা বলা হয়েছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি।
তবে সুবিদিত যে বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রকাশ্য আদালতে বিচারলাভ নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আর প্রকাশ্য আদালতে বিচার মানেই হলো এখানে সওয়াল-জওয়াব, যুক্তিতর্ক যা কিছুই ঘটুক না কেন, তার ওপর সাধারণভাবে কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এটা আদালতের নয়, জনগণের সম্পদ। ধরেই নিতে হবে, জনগণ সেখানে উপস্থিত থেকে প্রতিটি মুহূর্ত সবকিছু দেখছে ও শুনছে। ‘বিচারপতিদের জবাবদিহি জনগণের কাছে’—এ কথা প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন সুপ্রিম কোর্টের নতুন বার্ষিক প্রতিবেদনে পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে সিসিটিভি স্থাপনের দাবি বিচারপতিরাই তুলেছেন। তাঁরা বলেছেন, এজলাসে কোনো বিচারপতি প্রাইভেসি দাবি করতে পারবেন না। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে সাংবাদিকেরা অডিও টেপ ব্যবহার করতে পারেন কয়েক দশক আগে থেকেই।
বিশ্বব্যাপী বিচারক, আইনজীবী ও আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন যে প্রকাশ্য বিচার কার্যক্রমের সবটাই অবিকল তাৎক্ষণিক প্রচারিত হবে। এ বিষয়ে ব্যক্তিবিশেষের পছন্দ–অপছন্দ বা কারও রক্ষণশীল মনোভাব থাকতে পারে, কিন্তু সম্ভাব্য এ অগ্রগতিকে বাধা দেওয়ার সাধ্য কারও থাকবে না। নিয়ন্ত্রণ আরোপের তো প্রশ্নই নেই। কিছুদিন আগেই কিছুটা অসাবধানতাবশত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বিচারাধীন বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না করা বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু দ্রুতই তঁারা আরেকটি ‘স্পষ্টীকরণ’ বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তবে বিচারকার্য প্রভাবিত হয়, এমন খবর প্রত্যাশিত নয়। আমরাও আন্তরিকভাবে তাই বিশ্বাস করি।
প্রেস কাউন্সিল অবশ্য একই বিজ্ঞপ্তিতে সুপ্রিম কোর্টের ‘অবমাননা’ হয় এবং বিচারকদের ‘মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়’ অথবা ‘ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে’—এমন সংবাদ পরিবেশন থেকে সাংবাদিকদের বিরত থাকতে বলেছে। এর সঙ্গেও আমাদের দ্বিমত নেই। বরং প্রেস কাউন্সিল যখন বলে, ‘বিচারাধীন মামলার বিষয়ে প্রকৃত চিত্র পরিবেশন করা যাবে’, তখন ওই ‘কোর্টের সম্পদ’ দাবি করাটি সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। আমরা প্রেস কাউন্সিলের বিজ্ঞপ্তির, বিশেষ করে এ অংশটিকে স্বাগত জানাই যেখানে তারা বলেছে, ‘কোনো বিষয়ে সন্দেহের উদ্রেক হলে তা সংশ্লিষ্ট কোর্টের বেঞ্চ অফিসার, হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার এবং আপিল বিভাগের কাছ থেকে যাচাই করে প্রকাশ করতে হবে।’
এখানে যে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, সেটাই সারকথা বলে আমরা মনে করি। এটি একটি যথাযথ দিকনির্দেশনা।