১৯৯৮ সালে ৫৪ ধারায় রুবেল নামের এক ছাত্র আটক এবং পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনে তাঁর মৃত্যুর পর এ নিয়ে একটি রিট হয়েছিল। সেই রিটের সূত্রে আপিল বিভাগের কাছ থেকে একটি নির্দেশনা পাওয়া যায়। এ বছর প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চার (ক্যাট)-এর অধিবেশনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ কার্যত দাবি করেছে যে, আপিল বিভাগের এই নির্দেশনা তারা মেনে চলছে। আসল সত্য হলো, নির্দেশনাটি মানা হচ্ছে না। আর মানতে চায় না বলেই রিভিউ করে ওই নির্দেশনার ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে রাখা হয়েছে। আমরা বারবার বলেছি, এ নির্দেশনা সারা দেশের পুলিশ যাতে মেনে চলে, সে জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত এটিকে একটি পরিপত্র হিসেবে ঘোষণা করা। তা না করার একটি ফল হচ্ছে আবু সাঈদ উপাখ্যান।
হাজারীবাগের কিশোর আবু সাঈদ খুন হয়নি। সরকার গুম প্রসঙ্গে প্রায়ই বলে যে অনেকে ইচ্ছা করে ‘গুম’ হয়, তারই একটা নমুনা সাঈদ। কিন্তু পুলিশের কাজ ছিল এটা যে খুন নয়, গুম নয়—তা প্রমাণ করে সরকারের দাবিকে সত্য প্রমাণ করা। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টো। যে খুন হয়নি, তাকে খুঁজে পাওয়ার পর মামলার আসামিপক্ষ, যাঁরা জেল খেটেছেন, তাঁরা সংক্ষুব্ধ হয়ে প্রতারণার মামলা করেছেন। সেই মামলার আসামি হিসেবে সাঈদকে তার মা-বাবাসহ এক আত্মীয়কে ধরে হাজতে চালান করেছে। কিন্তু যে পুলিশ কর্মকর্তাটি ভুয়া অভিযোগপত্র দিলেন, তাঁর বিষয়ে আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখছি না।
তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পেয়েছেন বলেই তথাকথিত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন। পরিহাস হলো, এই মামলার বিচার কার্যক্রম চলেছে এবং এমনকি রায়ের জন্য দুবার তারিখ নির্দিষ্ট হয়েছিল। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, অভিযুক্ত পুলিশ নির্বিকারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, তিনি আসামিদের মাথায় ‘পিস্তল ঠেকিয়ে’ স্বীকারোক্তি আদায় করেছেন। সাজানো ‘আসামি’দের আইনজীবীরা যথার্থ বলেছেন, এটা জজ মিয়ার চেয়েও ভয়ানক নাটক।
সাঈদ যদি অভিমান করে পালিয়ে যায় এবং এরপর উদ্বিগ্ন মা-বাবা যদি থানায় গিয়ে অপহরণের মামলা করেন, তাকে অস্বাভাবিক বলা যায় না। এখানে দেখার বিষয় হলো আসামিদের হয়রানি করার জন্য সাঈদের মা-বাবা মামলাটি করেছিলেন কি না। প্রতীয়মান হয় যে সেটা তাঁরা করেননি। তার প্রমাণ হলো এজাহারে তাঁরা কখনো নাম দেননি। সুতরাং কাগজে-কলমে তদন্তকারী পুলিশকেই এর মূল দায় নিতে হবে।
আমরা এখানেই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আজ যদি দেশে গ্রেপ্তার ও রিমান্ড-সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইনটি কার্যকর থাকত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি সংবেদনশীলতা দেখাত, তাহলে হয়তো সাঈদের ‘খুন’ নামক উপাখ্যানটি তৈরির অবকাশই হতো না। কারণ, ওই গাইডলাইন মেনে চললে এ রকম ভুল হতো না বা অসাবধানতাবশত হলেও তা দ্রুত শুধরে নেওয়া সম্ভব হতো।
আমরা মনে করি, পুলিশ প্রশাসনের বাইরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দিয়ে এ ঘটনার একটি আশু তদন্ত হওয়া উচিত। হাজারীবাগ ও ডিবি উভয় স্থানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আচরণ তদন্তযোগ্য। সাঈদ খুনের আসামি হিসেবে সোনিয়া ৬ মাস, সাইফুল ২৪ মাস এবং আফজাল ৩৩ মাস জেল খেটেছেন। রাষ্ট্রকে অবশ্যই এর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আরও পরিহাস, শেষের দুই ‘আসামি’ শিশু কি না, আদালত তা পরীক্ষা করতে বলেছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত তার রিপোর্ট জমা পড়েনি।
আলোচ্য বিষয়টি হাইকোর্ট বিভাগের নজরে আনা হলে হাইকোর্ট দেখতে চাইছেন নিম্ন আদালত এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেন। ট্রাইব্যুনাল এই সাঈদ সেই সাঈদ কি না, তা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আর কত কালক্ষেপণ করবে?