দেশে ডেঙ্গু মহামারি রূপ নিয়েছে কি নেয়নি, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে নীতি-আদর্শের যে মারাত্মক ধস নেমেছে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। অনেকে এটিকে মানবতাবোধের মহা বিসর্জন হিসেবেও চিহ্নিত করে থাকেন। রাজনীতি, প্রশাসন, সমাজ, শিক্ষাঙ্গন এমনকি ধর্মীয় স্থানগুলোও ধ্বংসের প্রলয় থেকে মুক্ত নয়।
দুই দিন আগে নারায়ণগঞ্জে এক মসজিদের ইমাম দ্বিতীয় শ্রেণির এক কন্যাশিশু ধর্ষণের দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি শুধু শিশুটিকে ধর্ষণ করে ক্ষান্ত হননি, নিজের অপরাধ ঢাকার জন্য সহযোগীদের নিয়ে হাসপাতাল থেকে মেয়েটিকে অপহরণ ও হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। এই ঘটনা আমাদের ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার দুর্বৃত্তায়ন ও জিঘাংসার কথাও মনে করিয়ে দেয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষালয়কে অত্যন্ত পবিত্র স্থান ভাবা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা থাকবেন, তাঁরা হবেন উন্নত চরিত্র ও অনুসরণীয় নীতি-আদর্শের প্রতীক। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের কারও কারও আচরণে বিপরীত চিত্রই উঠে এসেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা যখন এল, তখন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর চালচিত্রের দিকে একবার তাকিয়ে দেখা প্রয়োজন। যখন দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্যরা মিলে নির্বাচিত উপাচার্য প্যানেলের নাম অদলবদল করেন, তখন আর ভরসা রাখার কোনো জায়গা থাকে না। যখন কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধের জের ধরে সরকারি ছাত্রসংগঠনের পদাধিকারীরা পদবঞ্চিতদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন মনে হয় আদর্শ নয়, পেশিশক্তি তাদের একমাত্র আরাধ্য। অন্যদিকে বিরোধী ছাত্রসংগঠনটির নেতা-কর্মীরা কারাবন্দী নেত্রীর মুক্তির দাবিতে রাস্তায় মিছিল বের করতে না পারলেও পদ–পদবি রক্ষা করতে অভিভাবক প্রতিষ্ঠানটির সদর অফিসে তালা ঝুলিয়ে, ভাঙচুর করে নিজেদের শক্তিমত্তা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেন না।
আমরা প্রশাসনের দিকে চোখ ফেরালে প্রায় একই চিত্র দেখতে পাই। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাংলাদেশের এযাবৎ গৃহীত সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প। নিরাপত্তা ঝুঁকি সত্ত্বেও দেশবাসী মনে করেছিল, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু প্রকল্পের আবাসিক ভবনের কেনাকাটা নিয়ে যে ‘পুকুরচুরি’ হয়েছে, তাতে সন্দেহ জাগে লাভের গুড় পুরোটাই না পিঁপড়ায় খেয়ে ফেলে। ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে যখন সারা দেশের মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে, তখন অভয়ের বাণী না শুনিয়ে কোনো একজন প্রতিমন্ত্রী বলে বসলেন, ডেঙ্গু আসা উন্নয়নের লক্ষণ। তাঁর এই মন্তব্য আক্রান্ত মানুষগুলোর প্রতি নিষ্ঠুর উপহাস বলেই ধারণা করি।
কয়েক দিন আগে নিছক গুজবের ওপর ভর করে গণপিটুনিতে একের পর এক মানুষ হত্যা করা হচ্ছিল। এই সংঘবদ্ধ নৃশংসতা দমনে রাষ্ট্রযন্ত্র যতটা সক্রিয় ছিল, সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা তার চেয়ে বেশি তৎপর ছিলেন প্রতিপক্ষের ওপর দায় চাপাতে। কিন্তু যেসব নিরীহ নারী-পুরুষ গণপিটুনির শিকার হলেন, তাঁদের স্বজনদের কাছে সরকারি বা বিরোধী দলের পক্ষ থেকে কেউ সমবেদনা জানাতে গিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। জনকল্যাণের জন্য যে রাজনীতি, সেই রাজনীতির কুশীলবেরা যখন মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় বিন্দুমাত্র কাতর না হয়ে সারাক্ষণ একে অপরকে দেখে নেওয়ার ও দেখিয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় মত্ত থাকেন, তখন প্রশ্ন জাগে এই নীতিবর্জিত রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? আমাদের রাজনীতিকেরা ব্যক্তিগত বা ঘরোয়া আলাপে এক কথা বলেন, আর মঞ্চে সভায় গিয়ে ঠিক তার বিপরীত বাক্য উচ্চারণ করেন। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা দেখে জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতার পঙ্ক্তিই মনে পড়ে: ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ/যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই/পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া ।’